ছবি: বাংলাবার্তা
পবিত্র রমজান মুমিনের ইবাদতের বসন্তকাল। রোজা বা সংযম পালন ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। পবিত্র রমজানের আগমনে মুমিন বান্দা প্রস্তুত হয় নিজেকে গুনাহমুক্ত করে রবের পূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আর একদল অসাধু ব্যবসায়ী রমজানের আগেই মজুতদারি করে প্রস্তুতি নেন কীভাবে দাম বাড়ানো যায়- এ নিয়ে। মজুতদারি রোধে ইসলামের শাস্তি ও নির্দেশনা নিয়ে বাংলাবার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, স্যোশাল এক্টিভিস্ট মাওলানা সাইমুম সাদী।
বাংলাবার্তা : মজুতদারি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানো সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
মাওলানা সাইমুম সাদী : ইদানীং নীতি নৈতিকতা লোপ পাচ্ছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে বেশি লাভের আশায় অবৈধভাবে পণ্য মজুত করে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ক্রেতাদের সংকটে ফেলেন তারা। অথচ অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্য মজুত করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, হারাম। ভোক্তাদের জিম্মি করে অর্থ উপার্জন সামাজিকতা ও মানবিকতা বিবর্জিত। উপরন্তু এগুলো জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হবে। মানবতার মুক্তিরদূত প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, মহান আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৩৮)
বাংলাবার্তা : জনসাধারণকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কষ্ট দেয়া সম্পর্কে ইসলামের বিধান কী?
মাওলানা সাইমুম সাদী : জনসাধারণকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কষ্ট দেয়া জায়েয নেই- সম্পূর্ণ হারাম। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এভাবে
অবৈধ সম্পদ উপার্জনকারীকে তার সম্পদই জাহান্নামে নেবে। ভোক্তাদের জিম্মি করা জায়েজ নয়। কেউ তা করে ‘বিত্তশালী’ হয়ে গেলেও লাভ নেই। তার অবৈধ সম্পদ জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। দুনিয়ার জীবনও তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। উপরন্তু এতে উপার্জিত অর্থ হারাম হওয়ার কারণে নামাজ, রোজা, হজ, দান-সদকা কিছুই কবুল হবে না।
বাংলাবার্তা : রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ দাম কমানোর ঘোষণা দেয়, আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়- আপনার মতামত কী?
মাওলানা সাইমুম সাদী : ভারতে দুর্গাপূজার সময় পণ্যের দামে ছাড় দেয়া হয়। খ্রীস্টানদের বড় দিনে ২০-২৫ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের মুসলিম দেশে ভিন্ন চিত্র। পণ্যের দাম কমানো তো দূরের কথা, ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের জিম্মি করে আদায় করে নিচ্ছেন বাড়তি টাকা। পাশাপাশি ভেজালে সয়লাব বাজার। অবশ্য রমজান উপলক্ষে এরাবিয়ান দেশগুলোতে দাম কমানো হয়। বরং দাম কমানোর প্রতিযোগীতা শুরু হয়। পণ্যের দামে প্রায় ৩০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়। দাম কমানোর তালিকায় আছে- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, মিসর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। ইউরোপ-আমেরিকায়ও বিভিন্ন কার্ডে রয়েছে নানা ছাড়।
বাংলাবার্তা : মজুতদারি রোধে করণীয় কী বলে মনে করেন?
মাওলানা সাইমুম সাদী : মজুতদারি রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাসহ সরকারের নজরদারি একান্ত প্রয়োজন। রমজান এলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের দমনে এ উদ্যোগগুলো নেয়া যায় বলে মনে করি-
১. বাজারে পণ্য যখন ব্যাপক আমদানী হয় তখন অত্যধিক মুনাফা লাভের প্রত্যাশায় মুনাফাখোররা সস্তা দামে তা ক্রয় করে মজুত করে রাখে এবং বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। সুতরাং মুনাফাখোরী ও মজুতদারী প্রতিরোধের জন্য সর্বাগ্রে সরকারীভাবে মজুতদারীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
২. মুজতদারী প্রতিরোধের এক কার্যকর ও বলিষ্ঠ উপায় হচ্ছে যাকাত। কারণ মজুতকৃত সম্পদের উপরেই যাকাত ধার্য করা হয়ে থাকে। সুতরাং সরকারীভাবে যাকাত আদায়কে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. মজুতদারির ফলে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি হলে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে ন্যায্য মূল্যে খোলা বাজারে সরকারীভাবে পণ্য বিক্রি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যতক্ষণ না পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক ও সহনীয় হয় এবং মজুতদাররা তাদের মজুতদারী থেকে নিবৃত্ত হয়। এ লক্ষ্যে সরকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে পূর্ব থেকেই মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানী করে বা দেশজ উৎস থেকে সংগ্রহ করে মজুত করে রাখবেন।
৪. মজুতদারির ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলে জনসাধারণের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার মজুতদারদেরকে তাদের মজুদকৃত পণ্য বাজারের প্রচলিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য করবেন।
৫. যদি মুনাফাখোর ও মজুতদাররা সরকারের নির্দেশ অমান্য করে তাহলে সরকার তাদেরকে শাস্তি দিবেন, যাতে অন্য কেউ এ কাজে দুঃসাহস না দেখায়। ওমর ও আলী (রা.)-এর যুগে মজুতদারির প্রবণতা দেখা দিলে তারা প্রথমতঃ মজুতদারদেরকে নসিহত করতেন অতঃপর নসিহত না শুনলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতেন।
বাংলাবার্তা : সৎ, আমানতদার ব্যবসায়ীর ফজিলত কী?
মাওলানা সাইমুম সাদী : মজুতদারি না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করল, এ ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদতে। তার উপার্জন মহান আল্লাহ বরকতময় করে দেবেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর পণ্য মজুতদকারী অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ : ২/৭২৮)
তিনি আরও বলেন,‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯) সৎ, আমানতদার ব্যবসায়ীর জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে? একজন ব্যবসায়ী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।
বাংলাবার্তা : বাংলাবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মাওলানা সাইমুম সাদী : সুন্দর ও সময়োপযোগী বিষয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করায় বাংলাবার্তাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ