ছবি: বাংলাবার্তা
ইসলামের প্রতিটি কাজ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি মুক্ত। ইসলাম মানবতার মুক্তির একমাত্র ভারসাম্যপূণ্য ধর্ম। আমাদের প্রতিটি কাজ হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার বাইরে গিয়ে যতো বেশি আমলই করা হোক তা মহান আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। শবে বরাতও ঠিক তাই। শবে বরাতে নবীজি (সা.)-এর আমল আমাদের জন্য আমলযোগ্য।
শবে বরাতের দোয়া কবুল হয়
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পাঁচটি রাত এমন আছে, যে রাতে বান্দার কোনো দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। আর তা হলো-জুমার রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, নিসফে শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতর তথা রোজার ঈদের রাতের দোয়া, ঈদুল আজহা তথা কুরবানির ঈদের রাতের দোয়া।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭৯২৭)।
নবীজি (সা.) দীর্ঘ রাত পর্যন্ত নফল নামাজ আদায় করেছেন
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে এত দীর্ঘ সময় সেজদায় রইলেন যে, আমার ধারণা হলো, হয়তো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন আমি তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিয়ে দেখলাম। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, ওহে হুমাইরা! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না হে আল্লাহর রাসুল! আপনার দীর্ঘ সেজদায় আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত। মহান আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন, বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই’ (শুয়াবুল ঈমান : ৩৫৫৪)।
তাওবা ও ইস্তেগফার করা
শবে বরাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা। কারণ বরকতময় এই রাতে মহান আল্লাহ প্রথম আকাশে এসে বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। তাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তখন মহান আল্লাহ প্রথম আকাশে অবস্থান করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া অন্যদের ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে বাজজার : ৮০)
মহান আল্লাহ বান্দাদের ডাকেন
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আলী বিন আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অর্ধ শাবানের রাত তোমরা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছো কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করবো। আছো কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করবো। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত মহান আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)
অনেকে শবে বরাতের ফজিলত বিষয়ক সকল হাদিসকে জয়িফ বলে থাকেন। এটি ঠিক নয়। সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা, যা ইবনে হিববান বর্ণনা করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০; সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)
উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে এ রাতের ফজিলত যেমন জানা যায়, একইভাবে এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তাও বোঝা যায়। অর্থাৎ এ রাতে দীর্ঘ নামাজ পড়া, সেজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া ও ইস্তেগফার করা খুবই ফজিলতপূর্ণ আমল। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, বর্ণিত আছে, পাঁচ রাত্রিতে দোয়া কবুল হয়, তন্মধ্যে একটি লাইলাতুল বরাতের দোয়া।’ (কিতাবুল উম্ম-১/২৬৪)
কবর জিয়ারত করা
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক রাতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? আয়েশা (রা.) বলেন, আমার ধারণা হয়েছিল, আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন মহান আল্লাহ এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৭৩৯)
উল্লেখ্য, তদানীন্তনকালে উল্লিখিত গোত্রে বিপুল পরিমাণ বকরি ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কথায় মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যাধিক্য বুঝাতে চেয়েছেন।
শবে বরাতে বিরত থাকা
শবে বরাতে বিশেষ পদ্ধতির কোনো নামাজ নেই। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকেও এ ধরণের প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে প্রচলিত বিশেষ পদ্ধতির নামাজের কথা বলা আছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। শবে বরাতের সব আমল একাকি- সম্মিলিত আমল নেই। পাশাপাশি মসজিদ, ঘর-বাড়ি বা দোকানপাটে আলোকসজ্জা করা, পটকা ফুটানো, আতশবাজি, কবরস্থান ও মাযারে ভিড় করা, কবরস্থান ও মাযারে আলোকসজ্জা করা, মহিলাদের বিনাপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষত বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাযার ইত্যাদিতে ভিড় করা, তরুণ ও যুবক ছেলেদের সারারাত শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো, হৈ-হুল্লোড় করা―এসব কিছুই আপত্তিকর কাজ। এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি মুক্ত হয়ে নবীজি (সা.)-এর মতো শবে বরাত পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ