ছবি: বাংলাবার্তা
জ্ঞান চর্চায় মহিলাদের মধ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নাম সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি কুরআন, হাদিস ইসলামী আইন প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। যে আটজন সাহাবি সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তৃতীয়। অনেক বিশিষ্ট সাহাবি ও তাবিয়ী তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আসমাউর রিজালের গ্রন্থগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লক্ষাধিক সাহাবির মধ্যে এক হাজার সাহাবির জীবনবৃত্তান্ত লেখা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫০ জন মহিলা। এ থেকে অনুমান করা যায় তৎকালে নারী শিক্ষার উপর কতা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার মহিলার নিকট লিখন পদ্ধতি শিক্ষা করতেন। বালাযুরী বলেন, আব্দুল্লাহর কন্যা আশ-শিফা ইসলামের পূর্বে লিখন পদ্ধতি শিখেছিলেন। তিনি আরও বলেন, ইসলামের প্রাথমিককালে মক্কায় যে ১৭ জন লেখাপড়া জানতেন, তাদের মধ্যে ৫ জন মহিলা ছিলেন। তিনি শুধু নারীদের নয় পুরুষদেরও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, বড় বড় সাহাবি ও তাবিয়ী তার নিকট হতে হাদিস, তাফসীর ও জরুরী মাসায়েল শিখতেন। হাদিসে এসেছে, ‘‘আবু মুসা বলেন, আমরা রাসুলের সাহাবিগণ যখনই কোনো সমস্যায় পতিত হয়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করেছি তখনই তার নিকট থেকে সেই বিষয়ে ইলম লাভ করেছি।’’
অপর একজন আয়েশা যিনি সাদের কন্যা ছিলেন, তিনি তার পিতার নিকট লেখাপড়া শিখতেন।
মহিলাদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ লাভের সঠিক, উপযুক্ত ও উত্তম ক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর ও পারিবারিক পরিবেশ। এ কারণে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব প্রথমত পিতা-মাতা ও স্বামীর ওপর অর্পণ করা হয়েছে। এ পর্যায়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একখানা নির্দেশের ভাষা এই- ‘‘তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট চলে যাও, তাদের সঙ্গে বসবাস কর, তাদের জ্ঞান শিক্ষা দাও এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য তাদেরকে আদেশ কর।’’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূণ্যশীলা স্ত্রীগণ সকলেই শিক্ষিত ছিলেন। মহিলা সাহাবিগণও শিক্ষিত ছিলেন। তাদেরই প্রজ্জ্বলিত শিক্ষার আলো সমস্ত মুসলিম জাহানের মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর তার অনুসারীগণ, ইসলামের খলিফাগণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্রাটগণ মানুষের মাঝে ইসলামের মহাত্মা প্রচারকে সার্থক করে তোলেন। সমাজের উন্নতি ত্বরাণ্বিত করার মানসে নারীরা পুরুষদের সাথে তাদের কর্তব্য পালনে কর্মসূচী গ্রহণ করেন।
পুরুষরা যেভাবে শিক্ষিত ও জ্ঞানী গুণী হয়ে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক হয়েছিলেন, যেভাবে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করে চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদিতে নিবেদিত প্রাণ হয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, তারকারাজীর তত্ত্ব ও তথ্যসহ অন্যান্য বিষয় আবিষ্কার করে তাদের মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন, তেমনই পুরুষের সঙ্গে নারীরাও শিক্ষিত হয়ে সাহিত্যি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের অনন্য অবদান রেখে গেছেন।
রাজনীতির ক্ষেত্রে আরব জাহানে ইসলামের অনেক প্রতিভাবতী মহিলার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, যা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ। তাদের মধ্যে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা অন্যতম। প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ফারুকে আযম উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং তার সিদ্ধান্তকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। শিফা বিনতে আব্দিল্লাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহা এর সিদ্ধান্তকে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু অনুমোদন করতেন। তিনি মহিলা বিষয়ক কোনো কোনো সরকারি কাজের দায়িত্ব শিফা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দিতেন।
কুরআনের তাফসীর বর্ণনা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বর্ণনায়, হাদিসের ব্যাখ্যায় সারা বিশ্বে মুসলিম জননীগণ বিশেষত উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সমস্ত মহিলা সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহা-দের তুলনায় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আর ৩৭৮ খানা হাদিস উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া উম্মে আতিয়া, আসমা বিনতে আবু বকর, উম্মে হানী এবং ফাতিমা বিনতে কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রমুখ মহিলা বহু সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। ফিকহ বিদ্যায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক এত অধিক ফাতওয়া রয়েছে, যা একত্রিত করলে বৃহৎ গ্রন্থ হয়ে যেতে পারে।
অনুরূপ উম্মে সালমা কর্তৃক বর্ণিত ফাতওয়াসমূহও একখানা পুস্তিকার আকার পেতে পারে। ফারায়েয বিষয়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও অন্যান্য মহিলা সাহাবি হাদিস, ফিকহ, তাফসীর, ফারায়েয, কিরাআত ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তারা অনেকে কুরআনের হাফিযা ছিলেন।
হিন্দ বিনতে উবায়েদ, উম্মে ইমাম বিনতে হারিসা, রাবিতা বিনতে হায়্যান, উম্মে সা‘দ ইবনে রবী রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রমুখ মহিলা সাহাবি পবিত্র কুরআনের বেশিরভাগ আয়াতের হাফিযা ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কুরআনুল কারিমের দরস দিতেন। সহীহ মুসলিমের শেষাংশে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক তাফসীরের কতকাংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
এতদ্ব্যতীত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা, সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু আনহা, জুওয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু আনহা, ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে শুরাইক রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে আতিয়া, আসমা বিনতে আবু বকর, লায়লা বিনতে কায়েস, খাওলা বিনতে তবীব, উম্মে দারদা, আতিকা বিনতে যায়েদ, সাহল বিনতে সুহাইল, ফাতিমা বিনতে কায়েস, যায়নাব বিনতে আবু সলিমা, উম্মে আয়মান, উম্মে ইউসুফ রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রমুখ যথাক্রমে পূণ্যশীলা মুসলিম জননীগণ, খাতুনে জান্নাত এবং মহিলা সাহাবিগণও বহু সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা একত্রিত করলে কয়েকখান সুবৃহৎ গ্রন্থ হতে পারে। মজলিসে বয়ান ও বক্তৃতায় আসমা বিনতে সাকান রাদিয়াল্লাহু আনহা যশস্বী ছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আসমা বিনতে উমায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহা অনন্য ছিলেন। তাদের মধ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা, হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে কুলসুম বিনতে উক্বা রাদিয়াল্লাহু আনহা, করীমা বিনতে আল্-মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহা ভাল লেখাপড়া জানতেন এবং তারা গভীর জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন।
মুসলিম মহিলাগণ সাহিত্য চর্চায়ও অগ্রগামী হয়ে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন। অবশ্য ইসলামী যুগ থেকে আরবের নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যেই সাহিত্য সাধনায় উৎসাহ ও উদ্দীপনা বিদ্যমান ছিল। সেখানে জাকজমকের সাথে কবিতার মজলিস বসতো। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজে কবিদের আসরে প্রধান অতিথি হতেন অথবা সভাপতির আসন গ্রহণ করে আসরে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। তার সুযোগ্য কন্যা উম্মূল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কবিতা রচনা করতেন। তিনি বহু কবিতা কণ্ঠস্থ করেছিলেন এবং কবিতা আবৃত্তি করতেন। অন্যদের মধ্যে খানসা, সওদা, সুফিয়া, আতিকা, উমামা, মুরদিয়া, হিন্দ বিনতে হারিস, যয়নাব বিনতে আওয়ান, আতিকা বিনতে যায়েদ, হিন্দ বিনতে আনাস, উম্মে আয়মান, করিলা, আবদারিয়া, কসবা বিনতে রাফে, মায়মূনা, বালাবিয়া, নেয়াম, রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রমুখ মহিলা কবিতায় অতিশয় খ্যাতি লাভ করেন। খানসা রাদিয়াল্লাহু আনহার মতো প্রতিভাবান মহিলা কবি সে যুগে পৃথিবীর বুকে বিরল। তার কবিতা পুস্তকাকারে ছাপানো হয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিদূষী কবি, ঐতিহাসিক ও একজন শক্তিশালী বক্তা ছিলেন। কেবলমাত্র তার বহুমুখী প্রতিভা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি ও বর্ণনা থেকে নিয়ে তার জীবনী লিপিবদ্ধ হয়েছে।
মুসলিম নারী ও পুরুষগণ উভয়েই সাধারণ শিক্ষার পর অনেকেই কারিগরী বিদ্যার বিভিন্ন শিল্পকাজে ও বাণিজ্যে, সেলাইয়ের কাজে, দ্রব্যশিল্পে, চামড়া রং এর কাজে, পশু পালনে,এমনকি হিসাব কিতাবে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ঐ সময়ে প্রায় সকল আরব মহিলা সাধারণভাবে নিজ নিজ কাজে মহিলারা অভিজ্ঞ ছিলেন। মুসলিম জননী সওদা রাদিয়াল্লাহু আনহা তায়েফের চামড়া প্রস্তুত করার পদ্ধতি জানতেন।
আরও পড়ুন : জুতার ওপর দাঁড়িয়ে জানাযার নামাজ পড়া যাবে?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হলে আরবের প্রায় সমস্ত তীব্ব বিদ্যার বিশেষজ্ঞরা তার চিকিৎসার ব্যাপার যা আলোচনা করতেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাই মনে রাখতেন। এই সময়ে ইবনে বালদা লতা-পাতা দ্বারা বর্তমান যুগের কবিরাজ হেকিমদের মত রোগের চিকিৎসা জানতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সংশ্রবে থেকে মুসলিম জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিভিন্ন রোগের ওষুধ সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করে পরবর্তীকালে তা মুসলিম মহিলাগণকে শিক্ষা দেন। মহিলাগণ যাঁরা ইলমে তীব্ব ও রোগী শুশ্রুষায় পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন, তাদেরকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুজাহিদ সৈন্যদের সেবা-শুশ্রুষার কাজেও নিয়োগ করা হতো। সাহাবি উরওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, ‘‘আমি উম্মূল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে অন্য কোনো মহিলাকে ইলমে তীব্ব ও অস্ত্রপচার বিদ্যার অতীব পারদর্শী হতে দেখিনি।
মহিলা সাহাবিগণ তাঁদের যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, উপলব্ধি ও দূরদৃষ্টি বলেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি মুসলিম জাতিকে দিক নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেছেন :
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সকল সাহাবির ফতোয়া সংরক্ষিত আছে তাঁদের সংখ্যা একশত ত্রিশের কিছু বেশী হবে। এদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়েই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তাঁদের মধ্যে আবার সাতজনের ফতোয়ার সংখ্যা এত বেশী যে, আল্লামা ইবনে হাযমের মতে তাদের ফতোয়াগুলো পৃথকভাবে একত্র করলে প্রত্যেকেরই একটি করে বিরাট গ্রন্থ হয়ে যাবে। এই সাতজনের মধ্যে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত ব্যক্তির সাথে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাও অন্তর্ভুক্ত।
ফতোয়া দানকারী সাহাবিদের দ্বিতীয় সারিতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহার মত মহিলা সাহাবিও রয়েছেন।
ফতোয়া দানকারী তৃতীয় আরও একদল সাহাবি আছেন। তাঁদের ফতোয়ার সংখ্যা খুব কম। এসব সাহাবিদের মধ্যে হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখের মত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। এই দলের মধ্যে উম্মে আতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা, হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু আনহা, সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা, লায়লা বিনতে কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহা, আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে শরীফ রাদিয়াল্লাহু আনহা, খাওলা বিনতে তাওরীত রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহা, মায়মূনা রাদিয়াল্লাহু আনহা, ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, ফাতেমা বিনতে কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহা, যায়নাব বিনতে উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে আয়মান রাদিয়াল্লাহু আনহা, উম্মে ইউসুফ রাদিয়াল্লাহু আনহা, গামিদিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রমুখ মহিলা সাহাবিগণও অন্তর্ভুক্ত আছেন। (ইলামুল মুয়াককিয়ীন, ১ম খ-, পৃ. ৯-১১)
জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য ছোট ও বড় নারী ও পুরুষ এবং কাছের ও দূরের সব রকমের লোকই মহিলা সাহাবিদের শরণাপন্ন হয়েছেন। মুসলিম উম্মাহ এসব মহীয়িসী নারীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে তাদের সামনে সত্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। নিজেদের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে কত লোক যে আসা-যাওয়া করতো আয়েশা বিনতে তালহার বর্ণনা থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন:
وَكَانَ النَّاسُ يَأْتُونَهَا مِنْ كُلِّ مِصْرٍ
“প্রত্যেক শহর ও জনপদ থেকেই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে লোক আসত।” (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১১৮)
হাদিসের গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায় যে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা, উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর এবং আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী সাহাবিদের ইজতিহাদি রায়েরও সমালোচনা করে তাঁদের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।
সাহাবিদের মধ্যে হাদিসের অনেক বড় বড় হাফিয ছিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাও তাঁদের একজন। আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর এবং আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া আর কোনো সাহাবির বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা এত অধিক নয়।
আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো প-িত ও ফিকহবিদ সাহাবিও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার জ্ঞান ও পা-িত্য সম্পর্কে তার নিজের এবং তার মতই আরও অনেকের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন :
مَا أَشْكَلَ عَلَيْنَا أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدِيثٌ قَطُّ فَسَأَلْنَا عَائِشَةَ إِلاَّ وَجَدْنَا عِنْدَهَا مِنْهُ عِلْمًا.
“আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা কোনো হাদিস নিয়ে সমস্যায় পড়লে সে বিষয়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করতাম এবং তার কাছ থেকে সে ব্যাপারে কোনো না কোনো জ্ঞান অবশ্যই লাভ করতাম।” (সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৩৮৮৩)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনে অনেক কিছু স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। মানুষ তার কাছে থেকে অনেক কিছু জানতে ও শুনতে পেরেছেন এবং অনেক হুকুম-আহকাম ও আদবের কথা তার থেকে বর্ণনা করেছেন। এমনকি বলা হয়ে থাকে যে, শরীয়তের এক চতুর্থাংশ আহকাম তার থেকেই বর্ণিত হয়েছে।’ (ফাতহুল বারী, ৭ম খ-, পৃ. ৮২-৮৩)
হাফিয ইবনে হাজার রহ. অন্য এক স্থানে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে হাদিস বর্ণনাকারী অষ্টাশিজন লোকের নাম উল্লেখ করার পর লিখেছেন যে, এসব ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক লোক তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে আছেন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মত রাজনীতিবিদ এবং আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মত মুহাদ্দিস ও ফকীহ। এদের সাথে আরও রয়েছেন সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিবের মত খ্যাতনামা তাবি‘য়ী এবং আলকামা ইবনে কায়েসের মত নামজাদা ফকীহ। তাঁদের মধ্যে যেমন স্বাধীন মানুষ এবং ক্রীতদাস ছিলেন, তেমনি ছিলেন নারী ও পুরুষ। (ফাতহুল বারী)
উমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনু আবু তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম এবং এঁদের মতো ২৩ জন শীর্ষস্থানীয় সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের সাথে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিভিন্ন বিষয়ে যে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, ইমাম যারকাশী এ কিতাবে সেগুলো উল্লেখ করেছেন। এসব মতামতের সংখ্যা ঊনপঞ্চাশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
‘আলইজাবাহ্’ কিতাবের ব্যাখ্যাতে বিশিষ্ট আলিম সাঈদ আল্-আফগানী বলেছেন, ‘‘আমি কয়েক বছর যাবত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার জীবন সংক্রান্ত গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। আমি তার মধ্যে এমন অলৌকিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়েছি যা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। বিশেষ করে তার জ্ঞান ছিল সমুদ্রতুল্য। জ্ঞানের দিগন্তে তিনি ছিলেন সমুদ্রবক্ষে উদ্বেলিত ঢেউয়ের মত। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত তার মধ্যে যে বিষয়ের জ্ঞানেরই সন্ধান করতে চান না কেন, চাই তা ফিকহ, হাদিস, তাফসীর, ইসলামী বিধান, সাহিত্য, কবিতা, ঘটনাপঞ্জী, বংশ তালিকা, গৌরবগাঁথা, চিকিৎসা বা ইতিহাস, যাই হোক না কেন, আপনি তার মধ্যে সব বিষয়ের সমাবেশ দেখতে পাবেন। এ ব্যাপারটা আপনাকে দস্তুরমত হতবাক করে দেবে। আপনি আরও অবাক হবেন, যখন দেখবেন এসব বিষয়ে তার পরিপক্কতা ও পরিপূর্ণতা এমন সময়ে হয়েছিল যখন তার বয়স আঠার বছর অতিক্রম করে নি।’’
উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহার জ্ঞান ভা-ার হতে মুসলিম উম্মাহ্ কি পরিমাণ লাভবান হয়েছে তা মুহায়রা বিনতে হুদায়রের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, হজ আদায় করার পর আমরা কয়েকজন মহিলা মদীনায় গিয়ে সাফিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহার খিদমতে হাযির হলাম। সেখানে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম যে, কূফার কিছুসংখ্যক মহিলা পূর্বেই তার খিদমতে বসে আছে। আমরা তাঁকে দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় এবং হায়েয ও নাবীযের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। এভাবে কত জায়গায় কত মানুষ যে তার নিকট হতে শত শত মাসআলা জেনে নিয়েছে তার সীমা সংখ্যা নেই।
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এরূপ বত্রিশজন রাবীর নাম বর্ণনা করার পর হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, এ ছাড়া আরও অনেক লোক তার নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এসব বর্ণনাকারীদের মধ্যে বিখ্যাত সাহাবি ও তাবি‘ঈ উভয় শ্রেণীর লোকই রয়েছেন।
মারওয়ানের একটি জরুরী বিষয় জানা প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি বলেন :
كيف نسأل أحدا وفينا أزواج النبي صلى الله عليه وسلم
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র পতœীগণ আমাদের মাঝে বর্তমান থাকতে আমরা কোনো বিষয় সম্পর্কে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করতে যাব কেমন করে? তাই তিনি লোক মারফত উম্মে সালামাকে জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন। তিনি তার সে সমস্যার সামাধান করে দেন।
সাহাবিগণের ইলমী মতপার্থক্য দূরীকরণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণ বিরাট ও ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহ. বলেন :
“সাহাবিগণের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হলে এবং উম্মুল মুমিনিনদের কেউ সে বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদিস বর্ণনা করলে, তারা সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করতেন এবং নিজেদের সমস্ত মতপার্থক্য পরিত্যাগ করে তা আঁকড়ে ধরতেন।” (যাদুল মাআদ, ৪র্থ খ-, পৃ. ২২১)
রুবাই বিনতে মুআওয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহা একজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহিলা সাহাবি ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে মাসআলা জানার জন্য আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমরও কখনো কখনো তার নিকট হাজির হতেন। এ থেকেই তার জ্ঞানের মর্তবা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। রুবাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একুশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে আয়েশা বিনতে মালিক, সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান, নাফে, উবাদ ইবনুল ওয়ালীদ, খালিদ ইবনে যাকওয়ান, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান, মুহাম্মদ ইবনে আকীল, আবু উবায়দা ইবনে মুহাম্মদ এবং আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ রয়েছেন।
ফাতিমা বিনতে কায়েস একজন বিশিষ্ট মহিলা সাহাবি ছিলেন। তার নিকট থেকে চৌত্রিশটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার হাদিসের রাবীদের মধ্যে কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, উরওয়া ইবনে যুবায়ের এবং আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান-এর মত সাহাবিগণ রয়েছেন। এছাড়া সুলাইমান ইবন ইয়াসার এবং শাবীর মত উচ্চ মর্যাদার তাবেয়ীগণও তার থেকে হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল আছেন।
উম্মে আতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আব্দুল বার রহ. লিখেছেন,
“তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যার জানাযার গোসলে শরীক ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বর্ণনা করেছেন। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার ব্যাপারে তার বর্ণিত হাদিসই মূলভিত্তি। সাহাবা এবং বসরার তাবেয়ী আলিমগণ তার নিকট থেকেই মৃতকে গোসল দেয়ার নিয়ম-কানূন শিখেছিলেন। এ ছাড়াও তার থেকে আনাস ইবনে মালিক, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন এবং হাফসা বিনতে সিরীন বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন।”
সাআদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের কন্যা আয়েশা এর ছাত্রদের মধ্যে ইমাম মালিক, আইয়ুব সাখতিয়ানী এবং হিকাম ইবনে উতায়বার মত ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণও রয়েছেন।
ইমাম শাফেয়ী রহ. হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতনী সাইয়িদা নাফিসা রহ.-এর কাছে গিয়ে হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেছেন।
মহান আল্লাহ আমাদের সমাজের নারীদেরও এভাবে গড়ে উঠার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ