
ছবি: সংগৃহীত
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া কুরআনের আয়াতগুলো কোনো সাহাবির চিন্তা বা মন্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও স্বীকৃত ব্যক্তি হলেন দ্বিতীয় খলীফা, ফারূকে আযম হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ছিলেন এমন একজন সাহাবি, যাঁর অন্তর ও জবানে আল্লাহ তাআলা সত্য সঞ্চার করে দিতেন।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন— “আল্লাহ তাআলা ওমরের মুখে সত্য ঢেলে দেন, সে যা বলে তা সত্য হয়ে যায়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৯৬২)
ইসলামের পথে ওমরের পদচারণা শুরু কুরআনের প্রেম থেকেই
ওমর রা. কুরআনের ঐশ্বরিক শক্তি দ্বারা অভিভূত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। কুরআনের প্রতি তার ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, পরবর্তীকালে নাজিল হওয়া অনেক আয়াত তার বক্তব্য ও প্রস্তাবনার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। ওমর রা. নিজেই উল্লেখ করেছেন এমন চারটি ঘটনা, যেগুলোর ক্ষেত্রে তিনি যা বলেছিলেন বা মনে করেছিলেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে কুরআনের আয়াতের মধ্য দিয়ে।
১. মাকামে ইবরাহীমকে নামাজের স্থান বানানো
ওমর রা. একদিন নবীজীকে প্রস্তাব দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যদি ‘মাকামে ইবরাহীম’কে নামাজের স্থান বানিয়ে ফেলি।” তার এই বক্তব্যের পরপরই নাজিল হয় সূরা বাকারা’র আয়াত:
“তোমরা ‘মাকামে ইবরাহীম’কে নামাযের স্থান বানাও।”
— সূরা বাকারা (২:১২৫)
এ ছিল কুরআনের আয়াত হিসেবে ওমর রা.-এর প্রস্তাবকে প্রত্যক্ষ সমর্থন।
২. স্ত্রীদের পর্দার নির্দেশ
ওমর রা. অনুভব করলেন, নবীজীর ঘরবাড়িতে নারীরা অবাধে চলাফেরা করছেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে পর্দার নির্দেশ দিতেন!” এরপরই নাজিল হয় হিজাব বা পর্দার বিধান সংক্রান্ত আয়াত।
এ ঘটনা কুরআনের সামাজিক বিধানকে রূপদান করার ক্ষেত্রে ওমরের প্রস্তাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার শক্তিশালী প্রমাণ।
৩. নবীজীর স্ত্রীদের সতর্কবাণী
একবার নবীজীর কিছু স্ত্রীগণ অভিমান করে একসঙ্গে অবস্থান নেন। তখন ওমর রা. বললেন, “রাসূল যদি তোমাদেরকে তালাক দেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দিয়ে তাঁকে প্রতিস্থাপন করবেন।” পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য আয়াত হিসেবে নাজিল হয়:
“সম্ভবত যদি রাসূল তোমাদেরকে তালাক দেন, তাহলে তার প্রতিপালক তাকে তোমাদের পরিবর্তে উত্তম স্ত্রী দান করবেন।”
— সূরা তাহরীম (৬৬:৫)
৪. বদর যুদ্ধের বন্দিদের ফয়সালা
বদর যুদ্ধের পর কুফরদের ৭০ জন বন্দি হয়। নবীজী সাহাবাদের পরামর্শ চান। আবু বকর রা. মুক্তিপণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। ওমর রা. বলেন, “আমরা আল্লাহর শত্রুদের হত্যা করে ফেলি।” নবীজী প্রথমে আবু বকর রা.-এর প্রস্তাব মেনে নেন।
কিন্তু এরপর কুরআনে নাজিল হয় আয়াত:
“ভূপৃষ্ঠে ব্যাপক শত্রুনিধন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নবীর জন্য বন্দি রাখা উচিত নয়... যদি আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকত, তবে মহাশাস্তি নেমে আসত।”
— সূরা আনফাল (৮:৬৭-৬৮)
এতে স্পষ্ট হয় যে, ওমর রা.-এর মতের সঙ্গেই ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি।
৫. মুনাফিক ইবনে উবাইয়ের জানাযা প্রসঙ্গ
মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযায় অংশ নিতে চাইলেন। তখন ওমর রা. বাধা দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তার জানাযা পড়বেন, অথচ সে তো অমুক-অমুক দিন এসব অপবাদ দিয়েছিল।”
নবীজী তখন বললেন, “আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদি আমি জানতাম সত্তরবার ইস্তিগফার করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, তবে আমি তাই করতাম।”
পরবর্তীতে সূরা তাওবার আয়াত নাজিল হয়:
“তুমি কখনোই তাদের জানাযা পড়ো না এবং তাদের কবরের পাশে দাঁড়িও না। তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং পাপী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।”
— সূরা তাওবা (৯:৮৪)
ওমর রা.-এর মত ও কুরআনের মিল: ওহির আগাম প্রতিধ্বনি
উপরোক্ত ঘটনাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ওমর রা.-এর বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া কুরআনের আয়াতের সঙ্গে মিলে গেছে। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
“তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে ‘মুহাদ্দাস’ (ইলহামপ্রাপ্ত) লোক ছিল। আমার উম্মতে যদি কেউ হয়ে থাকে, তবে সে ওমর ইবনুল খাত্তাব।”
— সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৪৬৯
হজরত ওমর রা.-এর জীবনী কেবল নেতৃত্ব, প্রশাসন বা ন্যায়বিচারের ইতিহাস নয়, বরং এটি কুরআনের সান্নিধ্য, তার ভাবের প্রতিধ্বনি এবং আল্লাহর ওহির ছায়া হয়ে ওঠার এক বিরল উদাহরণ। তাঁর অন্তরের কথাই কখনো কখনো পরিণত হয়েছে কুরআনের আয়াতে। এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন আল্লাহর এক বিশেষ নিকটবর্তী বান্দা, যার অন্তর ও মুখমণ্ডল দিয়ে আল্লাহ তাআলা ওহির পূর্ববার্তা পৌঁছে দিতেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ