
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বাড়ছে—জানাজার খাটিয়া বহনের সময় উচ্চস্বরে কালিমা বা জিকির করা কি ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক, না কি তা বিদআত? এই প্রশ্ন আরও গুরুত্ব পায় যখন কোনো এলাকার নতুন ইমাম এ নিয়ে মত প্রকাশ করেন এবং স্থানীয়দের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এ প্রতিবেদন সেই বিষয়টি নিয়ে কুরআন-হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং ইসলামী ফিকহের আলোকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরছে।
স্থানীয় ঘটনার প্রেক্ষাপট
একটি এলাকা ভিত্তিক ঘটনা বলছে, জানাজার খাটিয়া বহনের সময় একদল মুসল্লি সমস্বরে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এবং অন্যান্য কালিমা জিকির করতে থাকে। হঠাৎ স্থানীয় মসজিদের নতুন ইমাম সাহেব বিষয়টির প্রতিবাদ করে বলেন, "এইভাবে উচ্চস্বরে জিকির করা বিদআত।"
এই বক্তব্যে স্থানীয় কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ হন। তাদের যুক্তি ছিল—“আমরা তো আল্লাহর কালিমা পড়ছি, এতে দোষ কোথায়?” এতে দ্বিমত দেখা দেয় মুসল্লিদের একাংশে এবং ঘটনাটি তর্ক-বিতর্কে রূপ নেয়। অথচ ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি এ বিষয়ে অত্যন্ত পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্ট।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস: জানাজা বহনের সময় নিরবতা
ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদীস স্পষ্ট নির্দেশনা দেয় জানাজার খাটিয়া বহনের সময় মানুষ যেন চুপ থাকে এবং আখেরাত নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকে।
ইবনু জুরাইজ (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, "নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজার পেছনে চলার সময় অধিক চুপ থাকতেন এবং গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন।"
(সূত্র: মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬২৮২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৩১৫)
অন্যদিকে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি বলেন, "জানাজার পেছনে যেন শব্দ না হয় এবং আগুন বহন না করা হয়।"
(সূত্র: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৫১৫)
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের আমল
রাসূল (সা.)-এর সাহচর্যে বেড়ে ওঠা সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাবেঈগণ জানাজার সময় একান্ত নিরবতা বজায় রাখতেন।
সুনানে কুবরা (বায়হাকী) এবং আল-আওসাত (ইবনুল মুনযির)-এর বর্ণনায় জানা যায়, "সাহাবাগণ জানাজার পেছনে চলার সময় কোনো আওয়াজ করতেন না।"
(সূত্র: সুনানে কুবরা ৪/৭৪; আল-আওসাত ৫/৪২২)
ফকীহগণের মতামত
শুধু হাদীস বা সাহাবাগণের আমলেই নয়, বরং প্রসিদ্ধ হানাফী, মালিকী ও অন্যান্য মাজহাবের আলেমগণও বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, জানাজার সময় উঁচু আওয়াজে জিকির করা ‘মাকরূহ’ তথা অপছন্দনীয়।
বিখ্যাত ফিকহগ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে—
বাদায়েউস সানায়ে (২/৪৬): "জানাজার পেছনে মূলত নিরবতা কাম্য। জিকির করতে চাইলে তা অনুচ্চ স্বরে হতে হবে।"
ফাতাওয়া তাতারখানিয়া (৩/৩৭), মুখতারাতুন নাওয়াযিল (১/৪০৮), ফাতহুল কাদীর (২/৯৭), এবং ইমদাদুল ফাত্তাহ (পৃ. ৬৩৮)-এও একই বক্তব্য পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন নিরবতা গুরুত্বপূর্ণ?
জানাজার মুহূর্ত হল এক গভীর আধ্যাত্মিক সময়। একজন মুসলমানের জীবনের ইহকাল ও পরকালের সেতুবন্ধন হয় এই মুহূর্তে। ইসলাম চায়, জানাজার সময় যেন যারা অংশ নিচ্ছে তারা সবাই আখিরাতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকে, মৃতের জন্য দোয়া করে এবং নিজের মৃত্যুকেও স্মরণ করে। উচ্চস্বরে জিকির বা শোরগোল সেই ভাবগাম্ভীর্যকে ব্যাহত করে।
জানাজার খাটিয়া বহনের সময় সমস্বরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকির করাকে বিদআত বলা হলেও, এর মূল বক্তব্য হলো—এই আমল রাসূল (সা.) ও সাহাবাদের আমলের সঙ্গে সংগত নয় এবং শরিয়ত নিরুৎসাহিত করে। এ সময় একান্তভাবে নিরব থেকে মৃতের জন্য দোয়া ও নিজের পরকাল নিয়ে চিন্তা করাই ইসলামি শিক্ষার মূল ভিত্তি। যদি কেউ চায়, তবে নিরবে জিকির করতে পারে, কিন্তু সমস্বরে বা উচ্চস্বরে জিকির করা অনুচিত ও শরিয়তসম্মত নয়।
এই বিষয়ে সমাজের আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিন এবং মুসল্লিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার যাতে বিভ্রান্তি না ছড়ায় এবং জানাজার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পরিবেশ বিনষ্ট না হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ