
ছবি: সংগৃহীত
বিদেশে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে আবেদন করতে গেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ডকুমেন্ট হলো ব্যাংক স্টেটমেন্ট। অধিকাংশ দেশই ছাত্রছাত্রীদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে থাকার প্রমাণ চায়, যাতে স্পষ্ট হয় যে শিক্ষার্থী তার পড়ালেখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে সক্ষম।
তবে অনেক সময় দেখা যায়, যারা প্রকৃতপক্ষে এত পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে রাখতে সক্ষম নয়, তারা টাকার বিনিময়ে ভুয়া বা কৃত্রিম ব্যাংক স্টেটমেন্ট তৈরি করে থাকেন। এটি একটি সাধারণ অথচ জটিল ও নৈতিকভাবে বিতর্কিত প্রক্রিয়া, যা ইসলামি শরীয়তের আলোকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
কীভাবে কাজ করে এই ভুয়া স্টেটমেন্ট ব্যবসা?
এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যাংকে কিছুদিনের জন্য রাখার ভান করে থাকে। যেমন ধরুন, কোনো স্টুডেন্টের প্রয়োজন ৪০ লাখ টাকার স্টেটমেন্ট। তার কাছে এই অর্থ না থাকলেও, কিছু প্রতিষ্ঠান বলে—“আমাদের ৪০ লাখ টাকা ব্যাংকে আছে, আমরা আপনার নামে এই টাকা ৪ মাসের জন্য দেখিয়ে দিব। এর জন্য আপনাকে দিতে হবে ৫% সার্ভিস চার্জ বা ফি।”
ফলে ঐ ছাত্র বা তার পরিবার ব্যাংকে ২ লাখ টাকা জমা দিয়ে ৪০ লাখ টাকার স্টেটমেন্ট তৈরি করে নেয়, যা আসলে তাদের নিজস্ব সম্পদ নয় বরং শুধুই একটি “ডামি” হিসাব।
শরীয়তের দৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়া কতটা বৈধ?
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। কারণ এখানে একটি ভুয়া আর্থিক চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে যা বাস্তব সত্য নয়। এই ধরনের স্টেটমেন্ট মূলত একটি ঋণ, যা সীমিত সময়ের জন্য অ্যাকাউন্টে দেখানো হচ্ছে, এবং এই ঋণের উপর ব্যাংক বা দালালরা ‘ফি’ বা কমিশনের নামে অর্থ নিচ্ছে।
এই কমিশন প্রকৃতপক্ষে সুদ (রিবা) হিসেবে গণ্য হয়, কারণ এটি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা আদায়। ইসলামে ঋণের ওপর মুনাফা নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন—“আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন এবং ব্যবসাকে হালাল করেছেন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫)
বিকল্প কী?
যদি সত্যিই কারো উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রয়োজন হয়, তাহলে ইসলামসম্মত উপায়ে তা করা উচিত। যেমন:
সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণ করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা
নিজের বা পরিবারের প্রকৃত সঞ্চয় ব্যবহার করে স্টেটমেন্ট তৈরি করা
যাদের টাকা নেই, তারা কোনো আত্মীয় বা বন্ধু থেকে অস্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা নিয়ে জমা রাখতে পারেন—শর্ত হলো, এতে কোনো ধরনের অতিরিক্ত অর্থ লেনদেন (কমিশন/সুদ) করা যাবে না
এক্ষেত্রে অবশ্যই অ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ টাকা আছে, শুধুমাত্র সেটুকুই স্টেটমেন্টে উল্লেখযোগ্য হবে। অতিরিক্ত বা কাল্পনিক অঙ্ক দেখানো সম্পূর্ণ প্রতারণা এবং ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত।
প্রতারণা শুধু শরীয়তে নয়, আইনি দৃষ্টিতেও অপরাধ
এই ধরনের ভুয়া আর্থিক ডকুমেন্টেশন শুধু শরীয়তসম্মতভাবে হারাম নয়, বরং অনেক দেশের আইনেও এটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক দেশে স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল হওয়া, স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এমনকি ভিসা আবেদনকারীকে ডিপোর্ট করার ঘটনাও ঘটেছে। তাই শরীয়তের পাশাপাশি আইনগত দিকও বিবেচনা করা জরুরি।
শিক্ষা লাভ করা ইসলাম ধর্মে উৎসাহিত করা হয়েছে, তবে তার জন্য মিথ্যাচার, প্রতারণা বা সুদি লেনদেন করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। একজন মুসলমানের উচিত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—বিশেষত বিদেশে উচ্চশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—সততা ও শরীয়তের নীতিমালা মেনে চলা।
ভুয়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিয়ে ভিসা পাওয়া মানে একদিকে নিজের ঈমানকে বিপদের মুখে ফেলা, অন্যদিকে আইনগতভাবে নিজের ভবিষ্যত ধ্বংস করা। তাই, সাময়িক লাভের আশায় নাজায়েজ পন্থা গ্রহণ না করে হালাল ও জায়েজ পন্থাই বেছে নেওয়াই একজন মুসলমানের জন্য উত্তম।
বাংলাবার্তা/এমএইচ