
ছবি: সংগৃহীত
নারী সংশ্লিষ্ট অধিকার ও সংস্কার নিয়ে গঠিত নারীবিষয়ক কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের কিছু সুপারিশ নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ঘিরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদরা একে ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত মূল্যবোধের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমাদুল্লাহ তার বক্তব্য দিয়েছেন, যা জনমনে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে।
বৈবাহিক ধর্ষণ বা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি ইসলাম কীভাবে দেখে এবং বাস্তব সমাজে এটি কীভাবে প্রমাণ হবে—এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, "ওয়েস্টার্ন বা পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রায়ই শুধু মুখের কথা বা অভিযোগের ভিত্তিতে বহু ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়, যা মানবাধিকারের বড় ধরনের লঙ্ঘনের নামান্তর।" তিনি স্পষ্ট করেন যে, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে কিছুটা জোরাজুরি স্বাভাবিক, যদি তা সীমালঙ্ঘন না করে এবং দাম্পত্য মধুরতার ভেতর থেকেই পরিচালিত হয়।
শায়খ আহমাদুল্লাহ উদাহরণ দিয়ে বলেন, "ধরুন, কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলেন বা পকেট থেকে টাকা আদায় করলেন। এটাকে কি আমরা বৈবাহিক ডাকাতি বলবো? নিশ্চয়ই না। এ ধরনের ছোটখাটো জোরাজুরি দাম্পত্য জীবনের অংশ, এবং তা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।" তবে তিনি সতর্ক করে দেন, যদি স্ত্রী শারীরিকভাবে অক্ষম বা অসুস্থ হন, এবং সে অবস্থায় স্বামী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে, তাহলে সেটা অবশ্যই জুলুমের পর্যায়ে পড়ে। ইসলামে জুলুম হারাম এবং নিন্দনীয়।
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের বিষয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও বিবেক জাগ্রত করাই মূল। আইন দিয়ে দাম্পত্য জীবনের প্রতিটি সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে বৈবাহিক ধর্ষণের মতো অভিযোগ প্রমাণ করাও অত্যন্ত কঠিন। বাস্তব ক্ষেত্রে, মুখের অভিযোগ ছাড়া এর প্রমাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।”
শায়খ আহমাদুল্লাহ সতর্ক করে বলেন, যদি বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনিভাবে অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে তা দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক ভারসাম্য ভেঙে দেবে। সামান্য মনোমালিন্যের পরও স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সুযোগ পাবে, যা পরিবারে স্থায়ী অশান্তি, কলহ ও বিচ্ছেদের প্রবণতা বাড়াবে।
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদি এই ধরনের আইন চালু হয়, তবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাস আরও দুর্বল হবে। ফলস্বরূপ বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধন নিরুৎসাহিত হবে। মানুষ বৈবাহিক জীবন থেকে দূরে সরে যাবে। তখন অবৈধ সম্পর্ক ও অনৈতিক জীবনযাপনের বিস্তার ঘটবে।”
পশ্চিমা সমাজের উদাহরণ টেনে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, "আমরা দেখছি, ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে সন্তান জন্মহার ভয়াবহ রকম কমে গেছে। বহু দেশ সরকারিভাবে সন্তান জন্ম নিলে ভর্তুকি দিচ্ছে, প্রণোদনা ঘোষণা করছে। তবুও জন্মহার বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ, সেখানে পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।"
তিনি উদাহরণ দেন চীনের প্রসঙ্গ টেনে, যেখানে একসময় এক সন্তান নীতির কঠোর প্রয়োগ থাকলেও বর্তমানে সরকার নাগরিকদের বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে। কারণ, জনসংখ্যা সংকট এখন তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শায়খ আহমাদুল্লাহ এও বলেন, "শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার কিংবা বৈবাহিক ধর্ষণ ইত্যাদি ধারণাগুলোকে প্রচার করে সমাজ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব ধারণার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের যে স্বাভাবিকতা তা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। দাম্পত্য জীবনে রসায়ন ও মানবিক আবেগের যে গভীরতা তা এভাবে আইনি ফ্রেমওয়ার্কে আবদ্ধ করা হলে সমাজে দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ ফলাফল তৈরি হবে।"
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে তিনি বলেন, "বাংলাদেশের নারীর বাস্তবতা, জীবনযাত্রা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব এই কমিশন করে না। তাদের চিন্তা-চেতনা, জীবনধারা ও ভাষা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিকে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। অথচ বাংলাদেশের আপামর জনতার ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে এসব ধারণার কোনো মিল নেই।"
শায়খ আহমাদুল্লাহর বক্তব্যে একটি বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে—বাংলাদেশের মতো মুসলিম প্রধান, ধর্ম ও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ সমাজে পশ্চিমা আদল কিভাবে প্রভাব ফেলবে এবং তার দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ফলাফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা নিয়ে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ