ছবি: সংগৃহীত
অনলাইন বেটিং ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে। বেটিং ও গ্যাম্বলিংয়ের নীরব এক ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। এসব বেটিং ও গ্যাম্বলিং নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদকের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।
প্রতিবেদনের শুরুতেই আপনাদের দুটো দৃশ্যপট দেখিয়ে আনি।
সবুর (ছদ্মনাম) একজন পিকআপ ভ্যান চালক। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও ছয় জনের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এমনও দিন যায় তার যে সেদিন কোন কাজই জুটে না ভাগ্যে। একপ্রকারে দিনে এনে দিনে খাওয়া সবুর হঠাৎ একদিন তারই এক বন্ধুকে দেখে বেটিং সাইটে একটি ক্রিকেট ম্যাচে টাকা বাজি ধরতে।
এ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ সবুরের চক্ষু রীতিমতো চড়কগাছে উঠেছিল ম্যাচ শেষে বন্ধুর বাজ ধরে আয় করা টাকার পরিমাণ দেখে। তার বন্ধু ম্যাচে বাজি ধরেছিল ১ হাজার টাকা। সেই ১ হাজার টাকা ম্যাচ শেষে তার কাছে এসেছে ৭ হাজার টাকা হয়ে। দিনমজুর সবুরের কাছে পুরো বিষয়টি লাগে ভোজবাজির ভেল্কির মতো।
তার মনে পড়ছিল না কোনদিন সে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির খেটেও একদিনে এত টাকা আয় করতে পেরেছিল কি না। আর সে সময়ই সবুরের মনে ভাবনা আসে, বসে বসে মোবাইল টিপেই যদি একদিনে অল্প সময়ের ভেতর এতো অর্থ উপার্জন করা যায়, তাহলে শুধু শুধু কেন এতো পরিশ্রম? এই ভাবনা থেকেই সবুর সিদ্ধান্ত নেয় সেও বেটিং করবে।
যেমনটা ভাবনা, তেমনটাই কাজ। সেদিনই বন্ধুর সাহায্যে বেটিং সাইটে একাউন্ট খুলে নিজেকে অল্প সময়ে বিত্তবান হিসেবে গড়ে তোলার মিশনে নেমে যান তিনি।
শুরুতে ৫০০ (বোঝার স্বার্থে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধরে নেওয়া হয়েছে) টাকা নিজের বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে বেটিং সাইটের একাউন্টে ঢুকিয়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচে বাজি ধরেন সবুর। সবগুলোতে জয় না পেলেও সৌভাগ্যবশত তার একাউন্টে থাকা ৫০০ টাকা দিনশেষে পরিণত হয় তার ১৫০০ টাকায়। কিছু না বুঝেই বেটিং সাইটে বেট ধরার অর্থ চোখের পলকেই তিন গুণ হয়ে দাঁড়ায়।
এমন কাঁচা অর্থের লোভ স্বভাবতই সামলানো বড় দায়। লোভের বশবর্তি হয়ে জেতা ১৫০০ টাকাই তিনি ফের বেট ধরেন। এবারও তার লাভ হয়। ১৫০০ টাকা গিয়ে ঠেকে ২৫০০ তে।
বিষয়টা বেশ মজাদারই লাগছিল সবুরের কাছে। যে কারণে পুরো ২৫০০ টাকাই ফের বেটিংয়ে ব্যবহার করে ফেলে সে। কিন্তু এবারে আর ভাগ্য সহায় হলো না তার। পুরো টাকাটাই হেরে বসেন তিনি। নিজের লাভের টাকা তো গেলই, সঙ্গে গেল চালান খাটানো ৫০০ টাকাও।
এখানেই হয়তো গল্পটা শেষ হতে পারতো। কিন্তু সেটি হয়নি। সবুর তার হারানো টাকা উদ্ধার করতে ধার করে বেট ধরে। কিন্তু শুরুতে সবুর মুদ্রার যে পিঠটি দেখেছিল, এখন সে দেখা শুরু করে তার অপর পিঠটি।
বারবার চেষ্টার পরও ভাগ্য ফিরছিল না তার। পুরো বিষয়টা তার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে অল্প কয়েক দিনেই। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঋণের পরিমাণ।
ভাগ্য ফেরাতে বন্ধুর পরামর্শে খেলার ধরণ বদলায় সবুর। এবারে সে শুরু করে পুরোটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ক্যাসিনো খেলা। অনলাইন বেটিং সাইটে থাকা বিভিন্ন ধরণের ক্যাসিনো গেমের ভেতর এক প্রকারের খেলা স্লট গেম। গেম শুরু করেই কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই সবুরের টাকা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। অল্প টাকার স্লট থেকে জিততে থাকেন তিনি বড় বড় দান। কখনো স্লট মিলছিল পরপর। আবার কখনোবা লম্বা সময় ধরে হতাশাই সঙ্গী হচ্ছিল তার। কিন্তু সবুরের জন্য সবচেয়ে স্বস্তিকর বিষয়টি ছিল যে, ক্যাসিনোতে একবারে তার যত টাকা খরচ হতো দিনশেষে তার চেয়ে বেশি তার আয় থাকতো।
এভাবেই মোটামুটি কয়েকদিন পার করে ফেলে সে। এর ভেতর কিছু ঋণও শোধ হয় তার। কিন্তু এখনেও যে মুদ্রার অপরপিঠ দেখা লাগবে সবুরের সেটি হয়তো তিনি ভাবনাতেই আনেন নি।
শুরুতে লাভ এনে দেওয়া গেমগুলোই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। ব্যর্থতার বেড়াজাল ছিড়ে বের হতে গিয়ে ফের তাকে পড়তে হয় অনলাইন গ্যাম্বলিংয়ের কালো থাবার ভেতরে। হারানো টাকা পুনরুদ্ধারের মিশনে বার বার অর্থ বেটিং সাইটে ব্যয় করতে থাকলেও সেটি আর ফেরত পাওয়া হয় নি সবুরের।
একদিকে বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা, আরেকদিকে গচ্চা দেওয়া টাকা যে কোনো মূল্যে ফিরে পাবার দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু একটা দিন সেই সংকল্প পথিমধ্যেই ছেড়ে দিতে হয় তাকে। বাস্তবতার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সবুর। আর সেই সঙ্গে স্ত্রী ও চার মেয়ে সহায়সম্বলহীন, অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে।
এবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক আরেকটি চরিত্রের সঙ্গে। নতুন এই চরিত্রের ছদ্মনাম ধরে নেওয়া যাক সাইদুল। বয়স ২৯। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ করে ঢুকেছেন চাকরিজীবনে। একজন সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডিলারের একাউন্ট সামলানোর গুরুভার পান তিনি। এই সাইদুলও দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন বেটিং সাইটের ক্যাসিনো খেলায় আসক্ত।
পরিবারের ধারণা ছিল চাকরিতে ঢুকে গেলে পরিবর্তন আসবে তার। কিন্তু চাকরিজীবনে প্রবেশের পর তার আসক্তির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পড়াশোনারত অবস্থায় বেশ কয়েকবার সাইদুলের ধার করে ক্যাসিনোতে খেলে হারানো অর্থ শোধ করেছে পরিবার। এমনটা হয়েছে অগণিতবার। কিন্তু কিছুতেই বোধদয় হয়নি এই তরুণের।
বিপথে যাওয়া ছেলেকে পথে ফেরাতে তার কাধে আরও দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে বিয়ে করানো হয়। কিন্তু তাতেও পথে ফেরানো যায়নি সাইদুলকে। বরং দিনকে দিন তার আসক্তির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছিল। একটা সময় সাইদুলের ঋণের দায় নিতে অস্বীকৃতি জানায় পরিবার। আর তখনই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার।
বাজির টাকার যোগান দিতে প্রায় সময়ই অফিসের ক্যাশের টাকা এদিক ওদিক করতেন সাইদুল। এমনকি অফিস থেকে তাকে কোথায় কোনো টাকা জমা বা পৌছে দিয়ে আসতে দিলে সেখান থেকেও টাকা সরিয়ে রাখতেন তিনি।
তবে একদিন যা ঘটলো সেটির আশা নিশ্চিতভাবেই কেউ করেনি কখনোই। যার অধীনে সাইদুল কাজ করতেন, তিনি একদিন সাইদুলকে লক্ষাধীক টাকা দিয়ে পাঠান কিছু পণ্য কিনে আনার জন্য। সেই টাকা নিয়ে পণ্য কিনতে সাইদুল রওয়ানা দেন ঠিকই, কিন্তু মাঝপথেই হয়ে যান নিরুদ্দেশ।
অনেক খোজাখুজির পরও মিলছিল না তার হদিস। এভাবেই কেটে যায় ছয়টি মাস। লম্বা সময় পেরিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত তার হদিশ খুজে পায় আইনশৃআইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া সাইদুলের খোজ মেলে পঞ্চগড়ে। সেখান থেকে নিয়ে আসা হয় তাকে।
আসলে কি হয়েছিল তার সঙ্গে? কেন হুট করেই টাকা।নিয়ে পালিয়ে গেলেন তিনি? উত্তরে সাইদুল শোনালেন ভীতিকর এক গল্প।
অনলাইন বেটিং সাইটে বিপুল পরিমাণ টাকা খুইয়ে ফেলার কারণে বড় অঙ্কের ঋণের বোঝার নিচে চাপা পড়েছিলেন সাইদুল। পাওনাদারদের কাছ থেকে লাগাতার চাপ আসায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। একসাথে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতে আসায় সবকিছুই যেন রিতীমত ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। যত টাকা নিয়ে তিন আত্মগোপনে চলে যান, সেটি দিয়ে শোধ করেন তার ঋণ। এরপর অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে ফের তিনি খেলা শুরু করেন তার ক্যাসিনো গেম।
এমন হাজারো সবুর-সাইদুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে। অনলাইনে বেটিং করে ভাগ্য ফেরে হাতে গোণা কিছু ব্যক্তির। বাকি সিংহভাগেরই পোড়া কপাল নিয়ে করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে হয়। অনেকেই প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর দৃড় সংকল্পের বলে ফিরে আসে সেই অন্ধকার জগত থেকে। তবে বেশিরভাগ মানুষের কপালে জোটে নিদারুণ পরিণতি। আর তাতে ভুক্তভোগীর পাশাপাশি বাজে সময় পার করতে হয় পুরো পরিবারকেও।
>বেটিং ও গ্যাম্বলিং কি?
ভদ্র ও উচ্চবিত্তদের জন্য তার নাম বেটিং। অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর লোকজন আর আম জনতার কাছে তার নাম জুয়া। নাম যেখানে যাই হোক না কেন এটি খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক অন্ধকার জগতের নাম।
একটা সময় প্রকাশ্যেই বসতো জুয়ার আসর। কোন রাখডাক ছাড়াই চলতো জুয়াড়িদের কার্যকলাপ। সময়ের পরিক্রমায় ও কঠোর বিধি-নিষেধের ফলে জুয়াড়িদের প্রকাশ্য দৈরাত্ম কমে আসে। দৌরাত্ম কমলেও তারা কিন্তু থেমে যায়নি।
প্রকাশ্যে না এসে এবারে তারা তাদের কার্যকলাপ চালাতে থাকে পর্দার আড়ালে বসে। প্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে তারা একেবারে আড়ালে থেকে কেবল মুঠোফোনের মাধ্যমে অন্ধকার এই জগতের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকে।
কিন্তু তাতেও যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না জুয়াড়িরা। নিত্য নতুন পন্থা উদ্ভাবন করে মানুষের দোরগোড়ায় তাদের এসব অনৈতিক কার্যকলাপ পৌছে দেয়াটাই একটা সময় হয়ে দাঁড়ায় তাদের মূল মিশন। আর সেই মিশনেরই ফল হিসেবে আবির্ভাব হয় বেটিং ওয়েবসাইটের।
সাইটগুলো এতটাই সহজলভ্য করে দেয় তারা যাতে করে যে কেউই যে কোন জায়গায় থেকে সহজেই প্রবেশ করতে পারে জুয়ার অন্ধকার জগতে। মানুষকে ভিন্ন স্বাদ এনে দিতে একটা সময় সেসব ওয়েবসাইটে যুক্ত করা হয় ভাগ্য নিয়ে খেলা জুয়া ক্যাসিনোর বহুল প্রচলিত খেলাগুলোকে।
সেই থেকে শুরু। যাত্রা শুরুর পর জনপ্রিয় হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি ক্যাসিনো সাইটের। প্রচুর চাহিদা থাকায় ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে থাকে নতুন সব ওয়েবসাইট। সবগুলোতে খেলার ধরণের কোন পার্থক্য না থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন সাইটে সব সময় দেয়া থাকতো ব্যবহারকারীদের জন্য চটকদার সব অফার। জুয়াড়িদের কাজ সহজ করতে আর ক্যাসিনো গেম থেকে নিছকই আনন্দ ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সহজ এক দুয়ার খুলে দিতেই জন্ম হয়েছিল এ সকল ওয়েবসাইটের।
শুরুতে এসব বেটিং সাইট উন্মুক্ত ছিল কেবলমাত্র সেসব দেশের মানুষদের জন্য যেসব দেশে কিনা বেটিং ও ক্যাসিনোর রয়েছে আইনগত বৈধতা। বেটিং ও ক্যাসিনোর দুয়ার যেসব দেশে ছিল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ, সে সব দেশের মানুষদের জন্য সাইটগুলোর দরজাও ছিল বন্ধ। সে কারণে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ যে সব দেশে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সে সব দেশের মানুষদের ছিল না এসব সাইটে একাউন্ট খোলার সুযোগ।
কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিশ্বব্যপী।
বেটিং ও গেম্বলিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে শুরুতে বাংলাদেশে এই বেটিং সাইটগুলোতে একাউন্ট খোলার উপায় ছিল না। ছিল না লেনদেনের মাধ্যম। কিন্তু হুট করেই সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন চলে আসায় ও দেশের ডিজিটাল লেনদেনের প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে বেটিংয়ের অর্থ লেনদেনের প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় বর্তমানে দেশের জন্য এট মহামারি আকার ধারণ করেছে।
বার্তাবাংলা/এনএ