প্রতীকী ছবি
অনলাইন বেটিং ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে। বেটিং ও গ্যাম্বলিংয়ের নীরব এক ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। এসব বেটিং ও গ্যাম্বলিং নিয়ে আমাদের বিশেষ তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
>কেন মানুষ দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে অনলাইন বেটিংয়ের দিকে?
কথায় আছে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকে বেশি। এছাড়া বেশিরভাগ মানুষই স্বভাবসুলভ দিক থেকেই চায় কম কষ্টে, কম পরিশ্রমে অল্প দিনেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হতে। আর সে সুযোগটাই কাজে লাগায় বেটিং কোম্পানিগুলো। শুরুতে তারা অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পাতে। প্রলোভন দেখানো হয় এক দিনেই লাখপতি হওয়ার! এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে যে কারো মনে স্বভাবতই ভাবনা আসবে, ঘরে বসেই যদি লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা যায় তবে ক্ষতি কি!
এমন ধারণা থেকেই মানুষজন এসব জুয়া খেলার সাইটে যুক্ত হচ্ছে। অর্থ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এসব বেটিং সাইটে যুক্ত হয়ে দিনশেষে সর্বস্ব হারাচ্ছে।
এসকল জুয়ার সাইটে যুক্ত হতে প্রথমেই দিতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। সেই টাকায় ডিজিটাল কয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে ধরতে হয় ‘বাজি’।
শুরুর দিকে লগ্নিকৃত টাকার যখন দুই তিন গুণ ফেরত আসে, তখনই মনে দানা বাধতে থাকে লোভ। বিনা শ্রমে বিপুল অর্থ আয়ের রঙ্গিন চশমা চোখে লাগিয়ে নিজ হাতেই বপন করে নিজের সর্বনাশের বিজ।
একটা সময় হুট করেই বদলে যায় খেলার দৃশ্যপট। শুরুতে যেখানে বিপুল লাভ দেওয়া হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় টানাটানি লাগে চালান নিয়েও। দেখতে দেখতেই হারিয়ে যায় তার সবটুকু অর্থ।
কিন্তু সব হারালেও মন ক্ষান্তি দিতে চায়না। কেননা ভেতরে যে তখন হারানোর চাপা ক্ষোভ। আর সেখান থেকেই জন্ম হয় জেদের। সেই জেদের কারণে হারটা হয় সেই ব্যক্তিটির। আর জয় হয় বেটিং কোম্পানির।
লক্ষ্য তাদের একটাই থাকে, যেভাবেই হোক আরো টাকা জোগাড় করে আবার ধরা হয় বাজি। কিন্তু হেরে গেলে সব টাকাই জলে! তখন টাকা উদ্ধারের জন্য আবারো আরো টাকা জোগাড় করে বাজি ধরার চক্রে পড়ে নিঃস্ব হতে হয়।
>অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর বিস্তৃতি কতখানি?
এই অনলাইন বেটিং সাম্প্রতিকসময়ে রিতীমত মহামারি আকার ধারণ করেছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেল পর্যন্ত সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারী ব্যাধী। দেশের আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও দেদারসে কোনো বাধা ছাড়াই গ্রাস করে চলেছে একটা প্রজন্মকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত এইসব অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর দৌরাত্ম বছর খানেক আগেও এত প্রকট ছিল না। সেটির বিস্তার ছিল কেবলই একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মানুষদের ভেতরেই। কিন্তু বছরখানেকের ভেতরেই এটি ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অলিগলিতে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সুযোগ নিয়ে লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে এই অনলাইন বেটিংয়ের কার্যক্রম।
শত নিষেধাজ্ঞা স্বত্বেও কোম্পানিগুলো দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তান্ডবলীলা। আর প্রতিনিয়ত সেই তান্ডবের বলি হতে হচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে। অল্পসময়ে টাকা বাড়ানোর তীব্র নেশাকে পুঁজি করে অনলাইন বেটিং কোম্পানিগুলো গ্রাস করছে সমাজকে। তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে যুবসমাজকে।
এভাবে সরাসরি অনলাইন গ্যাম্বলিং প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেওয়াতেও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারোরই৷ নেই কোন মাথাব্যথা এই ব্যধীটি নিয়ে।
>কিভাবে মানুষ জানছে এসব নিষিদ্ধ বেটিং সাইটগুলো সম্পর্কে?
সম্প্রতি এই বেটিং সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন খোলামেলাভাবেই টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে। দেশের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ কোন দ্রব্য, পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি নেই। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সেই বেসরকারী চ্যানেলটি তাদের একটি অনুষ্ঠানের টাইটেল স্পন্সর করেছে একটি বেটিং সাইটের অঙ্গসংগঠনকে। সেটি সরাসরি বেটিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না।হলেও প্রচারণা করে সেটি বেটিং সাইটের, আর অনুষ্ঠানের মাঝে প্রচার করছে সেই সাইটের বিজ্ঞাপন।
তবে টি-স্পোর্টসের দাবি তাদের এই বিজ্ঞাপন দেশের আইনের কোনভাবেই পরিপন্থী নয়। টেলিভিশন চ্যানেলটির মুখপাত্র বার্তা বাংলাকে জানান, 'দেখুন যদি সেই হিসাব করেন তাহলে তো দেশের বড় বড় কোম্পানির ব্যবসা করাটা কষ্টকর হয়ে যাবে। এই যেমন ধরেন যমুনা গ্রুপের মদের ব্যবসা আছে। তাই বলে তারা কি অন্য ব্যবসা করছ্র না?'
যেই যুক্তিই তিনি দাঁড় করান না কেন, দেশের একমাত্র স্পোর্টস চ্যানেল যদি খেলার বিরতিতে খেলারই এক কালো অধ্যায়ের প্রচার-প্রচারণা চালায় তবে বিষয়টি কতখানি যুক্তিযুক্ত সেই প্রশ্নের জবাবটা পাঠকদের জন্যই তোলা রইলো।
শুধু যে টিভিতেই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় বিষয়টি ঠিক তা নয়। অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক ইউটিউবেও। ফেসবুকে বুস্টিংয়ের মাধ্যমে আর ইউটিউবে কিছু ইউটিউবারদের ভিডিওর ভেতর অর্থের বিনিময়ে প্রচার করা হয় বেটিং সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন।
ইউটিউবের ভিডিওতে এই বিজ্ঞাপনের জন্য দাম হাঁকানো হয় ৭০ হাজার থেকে শুরু করে দেড়লাখ পর্যন্ত। আর টেলভিশনের কথা তো না হয় বাদই দেয়া যাক।
>হুট করেই কেন বেড়ে গেল এসব অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর ব্যপ্তি?
ধারণা করা হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত ক্লাবগুলোতে গোপনে চলা ক্যাসিনোগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই অনলাইন বেটিং ও গ্যাম্বলিংয়ের দিকে ঝুকে পড়ে নিয়মিত জুয়াড়িরা। ধীরে ধীরে সেটি ছড়িয়ে যায় দেশের অলিগলি পর্যন্ত।
আর যেহেতু কেবলমাত্র স্মার্টফোন থাকলেই বেটিং সাইটগুলোতে একাউন্ট খুলে ক্যাসিনোর মতো চটকদার গেম খেলা যায়, সেকারণেই এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়াও বেটিং সাইটগুলোতে একাউন্ট খোলার ও অর্থ বিনিয়োগের সহজলভ্যতাই এগুলো ছড়িয়ে পরার আরেকটি বড় কারণ। একটা সময় লেনদেনের জন্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু আন্তর্জাতিক গেটওয়ে দিয়ে ডলারে পেমেন্ট করার ব্যবস্থা থাকলেও ধীরে ধীরে এর চাহিদা ভেড়ে যাওয়ায় দেশীয় লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম সেখানে যোগ করে ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রকেরা আর এক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় বহুল প্রচলিত দেশীয় লেনদেনের গেটওয়েগুলোকে।
একজন একাউন্ট হোল্ডার খুব সহজেই মুহূর্তের ভেতর নিজেদের বেটিং একাউন্টে ক্রিপ্টোকারেন্সি যোগ করতে বিকাশ, নগদ, উপায়, রকেটের মতো অনলাইন লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারছে বলেই দ্রুত ঘটেছে এর বিস্তার।
বাংলাদেশের আইনে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও দেশের স্বীকৃত লেনদেনের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেই দেদারসে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সাইট কোম্পানিগুলো। না আছে এগুলোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত কোন তৎপরতা, না আছে সংশ্লিষ্ট আর্থিক গেটওয়েগুলোর চোখে পড়ার মতো কোনো তদারকি।
>কি বলছে বাংলাদেশের আইন?
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সকল প্রকার বেটিং, জুয়া ও ক্যাসিনো খেলা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধ করা হয়। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।' কিন্তু কি ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে তার কোন সুস্পষ্ট কথা উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশের জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য।
পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ এর ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ এর ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অর্থাৎ এই আইন শুধুমাত্র প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ডবিধি বর্তমান বাস্তবতার সাথে উপযোগী নয়।
তবে আশার কথা হচ্ছে জুয়া প্রতিরোধে নতুন আইন করছে সরকার। এজন্য নতুন ‘জুয়া আইন, ২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মূলত ১৮৬৭ সালের ‘দ্য পাবলিক গ্র্যাম্বলিং অ্যাক্ট’ যুগোপযোগী করে নতুন আইনটি করা হচ্ছে।
খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ২০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল।
বার্তাবাংলা/এনএ