ছবি: বাংলাবার্তা
অনলাইন বেটিং ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে। বেটিং ও গ্যাম্বলিংয়ের নীরব এক ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। এসব বেটিং ও গ্যাম্বলিং নিয়ে আমাদের বিশেষ তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন শেষ পর্ব।
>কেন এভাবে দেদারসে ছড়িয়ে পড়ার পরও আটকানো যাচ্ছে না বেটিং সাইটগুলোর কার্যক্রম?
সৃষ্টির শুরু থেকেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি থাকে মানুষের অতিরিক্ত আগ্রহ। সেই আগ্রহের কারণেই তৈরী হয়েছে আজকের এই পরিস্থিতি। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, সমাজের প্রতিটি শ্রেণিতেই আজ ছড়িয়ে পড়েছে নিরব ঘাতক এই বেটিং সাইটগুলো। কেউ সরাসরি খেলাতে বাজি ধরছেন, কেউবা খেলেন ক্যাসিনোর বিভিন্ন গেম।
এভাবে মহামারির মতো ছড়িয়ে পরার পরও বেটিং সাইটগুলোর কড়াল গ্রাস রুখতে প্রশাসনকে দেখা যায় নামমাত্র ভূমিকা পালন করতে।
যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জোর দাবি তারা এসকল সাইটের অবাধ বিচরণ রুখতে সদা তৎপর ও সদা সচেষ্ট। এগুলোর ব্যপ্তি রুখে দিতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেগুলোর সবই তারা ইতোমধ্যেই নিয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু বেটিং ওয়েবসাইট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।
বেটিং ওয়েবসাইটগুলোর ছড়িয়ে পড়া রোধে কি কি পদক্ষেপ ও নজরদারি করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা পুলিশের (সিআইডি) মুখপাত্র আজাদ রহমান বাংলা বার্তাকে বলেন, 'আমরা সবসময়ই এগুলোকে মনিটরিংয়ে রেখেছি। কিছুদিন আগেই আমরা এমনই একটি সাইটের চার মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া পেমেন্ট গেটওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমরা অনলাইন বেটিং সাইটের সঙ্গে জড়িত থাকায় আইনের আওতায় এনেছি। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। আমরা সদা তৎপর রয়েছি এই বিষয়টিতে। যখনই যাকে জড়িত পাচ্ছি তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। এটি আমাদের একটি চলমান প্রক্রিয়া।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যেই এমন বেশ কিছু ওয়েবসাইটের সকল ধরণের কার্যক্রম বিটিআরসির মাধ্যমে বন্ধ করে দিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে সেই সব ওয়েবসাইটে আর প্রবেশই করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে তাদের সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটিও এই প্রক্রিয়ার ভেতর আনা হবে শীঘ্রই। আমরা যখনই কোনো অভিযোগ বা তথ্য পাই, দ্রুততম সময়ের ভেতর সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।
গোয়েন্দা সংস্থার এই কর্তার কথায় এটি স্পষ্ট যে তাদের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন হয় কেবলমাত্র অভিযোগের প্রেক্ষিতে। এর বাহিরে তারা নিজেরা অনুসন্ধান করে খুজে বের করে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ইচ্ছে বা সময়টা হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভীড়ে হয়ে ওঠে না। যার সুবাদে অভিযোগের আওতায় না থাকা অসংখ্য বেটিং সাইট দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
এছাড়া আনুসন্ধানের সুবাদে বাংলা বার্তা যেই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছে সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারির আওতার বাহিরে থাকায় তারা হয়তো আচও করতে পারছে না। একটা প্রজন্মের ওপর কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে নিষিদ্ধ এই ওয়েবসাইটগুলো। ভয়াবহতার কেবল দুটো দৃষ্টান্ত আগের পর্বে সামনে এনেছে বার্তা বাংলা। এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই। সিংহভাগই নীরবে ঘটায় সেগুলো থেকে যায় লোকচোক্ষুর অন্তরালেই।
আরও পড়ুন: অনলাইন বেটিং এন্ড গ্যাম্বলিং: প্রচারেই প্রসার
তবে প্রতিবেদনের স্বার্থে করা বাংলা বার্তার অনুসন্ধানে গোয়েন্দা পুলিশের করা বেটিং সাইট বন্ধের দাবির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সাইটগুলোতে সাধারণ ও প্রচলিত ধারায় প্রবেশ না করতে পারলেও শুধুমাত্র ভিপিএন নামক ছোট্ট একটি অ্যাপস স্মার্টফোনে ইন্সটল করে নিলেই কোনো বাধা ছাড়াই প্রবেশ করা যাচ্ছে বিটিআরসির দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া সেসব ওয়েবসাইটগুলোতে।
একই সাথে আগের মতোই সকল কার্যক্রমও পরিচালনা করা যাচ্ছে অবাধেই। এ যেন সামনের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে পেছনের দরজা খুলে রাখার মতো অবস্থা।
>কিভাবে চলে এই লেনদেন কার্যক্রম?
প্রতিটা বেটিং সাইট আর্থিক লেনদেনের জন্য বেশ কিছু এজেন্ট নিয়োগ দেয়। এইসব এজেন্টদের কাজ হলো জুয়াড়িদের টাকা তাদের সাইটে থাকা একাউন্টে ট্রান্সফার করা।
সহজ করেই বলা যাক। ধরুন আপনি আপনার একাউন্টে ৫০০ টাকা ঢুকাবেন। সরাসরিও ঢুকাতে পারবেন। সাইটে দেওয়া কিছু বিকাশ বা নগদ নম্বরে টাকা সেন্ড মানি বা ক্যাশ আউট দিলেই আপনার দেওয়া অর্থ ক্রিপ্টোকারেন্সিরূপে জমা হবে আপনার একাউন্টে। তবে এক্ষেত্রে একাউন্টে ব্যালেন্স আসতে কিছুটা বিলম্ব হয়।
আর আপনি যদি এজেন্টদের মাধ্যমে একাউন্টে লোড করেন, তাহলে আপনার একাউন্টে টাকা ৫-১০ মিনিটের ভেতর যোগ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এজেন্টদের টেলিগ্রামে সিক্রেট গ্রুপ থাকে। এজেন্টদের বিকাশ বা নগদ নম্বরে সেন্ড মানি বা ক্যাশ আউট করে সেই টেলিগ্রাম গ্রুপে অর্থ প্রেরণের প্রমাণ দিলেই তারা একাউন্টে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করে দেয়।
অনেকেই আবার নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে অর্থ তাদের বেটিং একাউন্টে ট্রান্সফার করে নেন।
এই টাকাগুলো বিকাশ, নগদ, উপায়, রকেটের মতো দেশের ডিজিটাল লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। দেরারসে একদম ওপেন সিক্রেটের মতোই চলছে দেশের এ সকল গেটওয়ে ব্যবহার করে অবৈধ কার্যক্রম।
>বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত থাকা না থাকার বিষয়ে কি বলছে দেশের অনলাইন লেনদেনের প্ল্যাটফর্মগুলো?
যেহেতু দেশের বহুল প্রচলিত অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে বেটিং সাইটগুলো একাউন্ট হোল্ডারদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করে, তাই বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগের তীর ছুটে আসাটাই অতি স্বাভাবিক।
বেটিং সাইটগুলো তাদের লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অনলাইন লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম নগদ, বিকাশ, ইউক্যাশ, রকেট, উপায়ের মতো অনলাইন ট্র্যানজেকশন গেটওয়ে দিয়ে। টেলিগ্রামে এই সাইটগুলোর এজেন্টদের সিক্রেট গ্রুপ থাকে। সেখানে ডিপোজিটের জন্য প্ল্যাটফর্ম চাওয়া হলে এজেন্টরা গ্রাহকের সুবিধা অনুযায়ী পেমেন্ট গেটওয়ের একটি নম্বর প্রদান করেন। বিশেষ সেই নম্বরগুলোতে ইনকামিং কল যায় না। কল দিলে দেখায় নম্বরে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষায়িত সেই নম্বরগুলো ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র লেনদেনের কাজে।
আরও পড়ুন: যে অভিশাপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে একটি প্রজন্মকে
নম্বরে টাকা সেন্ড মানি অথবা ক্যাশ আউট করে সেই টেলিগ্রাম গ্রুপে টাকা প্রদানের স্ক্রিণশট দিতে হয়। কিছুক্ষণের ভেতরেই গ্রাহকের বেটিং সাইট একাউন্টে ডিজিটাল অর্থ যোগ হয়ে যায়।
একটি পরিসংখ্যান বলছে প্রতিদিন এইসব অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে বেটিংয়ের জন্য লেনদেন হয় অন্তত কয়েক কোটি টাকা। যার পুরোটাই কিনা অবৈধ। দেদারসে দেশের টাকা সবার চোখের অলক্ষ্যে চলে যাচ্ছে বিদেশে, যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সাইটগুলো।
স্বভাবতই মনে সন্দেহ জাগে, সত্যিই কি তবে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে কোনোভাবে কি জড়িত দেশের ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমগুলো?
কিন্তু তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পরও তার দায় নিতে চায়না ডিজিটাল লেনদেনের প্ল্যাটফর্মগুলোর কর্তারা। তাদের এইসব মাধ্যম ব্যবহার করে যে যাই করুক, তারা এর সাথে নিজেদের সরাসরি যুক্ত মানতে নারাজ।
নগদের হেড অফ কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল বাংলা বার্তাকে বলেন, 'এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা সরাসরি তো এর সাথে যুক্ত না। এখন আপনার ভাইকে আপনি টাকা দিলেন, সেই টাকা দিয়ে উনি অবৈধ কাজ করলো। তাতে কি আপনি দোষি হবেন?'
এদিকে বিকাশের মুখপাত্র শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, 'আমরা সবসময়ই এসব অবৈধ লেনদেন মনিটর করছি। আমাদের একটা টিমই রয়েছে এগুলো মনিটরিংয়ের জন্য। আমরা সবসময়ই কোনো সন্দেহজনক লেনদেন দেখলে বা কোনো অভিযোগ অথবা কোনো প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।'
বার্তাবাংলা/এনএ