ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: অনিয়মের মাধ্যমে লাইসেন্স পেয়ে প্রায় ২ যুগ ধরে বৈমানিক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিমান পরিচালনা করছেন ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন আল মাসুদ। যার এটিপিএল নাম্বার ৩২৩। বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের নিয়মিত সার্ভালেন্সের সময় ২০২২ সালের মার্চে মাসুদের লগবুকে অনিয়ম এবং ভুল তথ্য দিয়ে লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে।সিভিল এভিয়েশনের অনুসন্ধানে ক্যাপ্টেন মাসুদের জালিয়াতি উঠে এসেছে বলে বাংলাবার্তা নিশ্চিত হয়েছে।
বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সিভিল এভিয়েশন থেকে মাসুদের কাছে তার সবগুলো লগবুকের তথ্য চাওয়া হয়। এরপর সিভিল এভিয়েশন থেকে মাসুদকে শোকজ করা হলে ক্যাপ্টেন মাসুদ জানায়, তিনি দুবাইতে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সেখানে যাচ্ছেন ফলে তার পুরনো লগবুকগুলো দুবাইতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপর ক্যাপ্টেন মাসুদ বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭ এর ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। সেজন্য তার সকল তথ্য বাংলাদেশ বিমানে জমা দিতে হয়। বিমানের নিয়োগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিমান থেকে সকল প্রার্থীদের তথ্যাদি যাচাই করার জন্য সিভিল এভিয়েশনে পাঠানো হয়। তখন সিভিল এভিয়েশনের যাচাই বাছাইয়ে ক্যাপ্টেন মাসুদের সকল অনিয়ম ও ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে মাসুদের লগবুকে অনেকগুলো অনিয়ম ধরা পড়ে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ক্যাপ্টেন মাসুদের সিভিল এভিয়েশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট ফিলিপাইনে ফ্লাই করে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার লাইসেন্স নেন। তবে ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন মাসুদ সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার এফএসআর এবং পরিচালক এফএসআর এর কাছে একটি ইমেইল পাঠান। সেখানে দেখা যায়, মাসুদ ২০০১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ফিলিপাইনে ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট ফ্লাই করেছেন।
অপরদিকে সিভিল এভিয়েশনে মাসুদের জমা দেওয়া সার্টিফিকেট থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১১৮ ঘন্টা ১৮ মিনিট ফ্লাই করেছেন। সিভিল এভিয়েশনের কাছে যা অবাস্তব বলে বিবেচিত।
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ৪ মার্চ ফিলিপাইনে যান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসেন ২০০১ সালের ২৪ এপ্রিল। একজন বৈমানিক সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে ১ মাসে ১২০ ঘণ্টা ফ্লাইং করতে পারেন। তবে সপ্তাহে ৬ দিনের বেশি ফ্লাইং করা যাবে না বলে কড়া নির্দেশনাও রয়েছে। তদুপরি প্রত্যেক বৈমানিককে সপ্তাহে ১ দিন বাণিজ্যিক ফ্লাইট বাধ্যতামূলক বন্ধ রাখতে হবে।
এদিকে সিভিল এভিয়েশন বলছে, প্রশিক্ষণকালীন সময় একজন প্রশিক্ষণনোবিশ বৈমানিক যে পরিমাণ বিমান উড্ডয়ণ করতে পারে সেটা মাসিক ৪০-৫০ ঘণ্টার বেশি হওয়ার কথা নয়। ফলে ২১ দিনে ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাইং এবং ৭ দিনে ১১৮ ঘণ্টা ফ্লাইং করা কোনভাবেই সম্ভব নয় এবং আইনসিদ্ধ নয়। ক্যাপ্টেন মাসুদের জালিয়াতির বিষয়টি সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক এফএসআরআইএ এর নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধানেও ধরা পড়েছে।
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, ক্যাপ্টেন মাসুদের বাংলাদেশের লগবুক অনুযায়ী তিনি ২০০১ সালের মে মাসে বাংলাদেশে ফ্লাই করেছেন। আর ২০০১ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন থেকে বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়েছেন। মাসুদের প্রথম লগবুক অনুযায়ী ২০০২ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ফ্লাইং ঘন্টা ছিলো ২০৫ ঘণ্টার কিছু বেশি। যার মধ্যে ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাইং ফিলিপাইন থেকে করা।
অপরদিকে লগবুকের পরবর্তী পেজে ২০৫ ঘণ্টা থেকে দেখা যায় ৪১৬ ঘণ্টা। এই ২১১ ঘণ্টা ফ্লাইংয়ের কোন প্রমাণ সিভিল এভিয়েশনে দেখাতে পারেনি ক্যাপ্টেন মাসুদ। এমনকি ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিলের পর ঢাকা থেকে ফিলিপাইন যাওয়ার কোন প্রমাণ পায়নি সিভিল এভিয়েশন।
এদিকে ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশনের সাথে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন যোগাযোগ করে জানতে পারে,ক্যাপ্টেন মাসুদ ফিলিপাইনের ওরিয়েন্ট এভিয়েশন একাডেমি থেকে ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাইং করেছেন। যার মধ্যে ওরিয়েন্ট এভিয়েশনের স্বাক্ষর করা ক্যাপ্টের মাসুদের ফিলিপাইনের লগবুকে কপিতে দেখা যায়, ৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ফ্লাইং করেছেন ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। এছাড়া ২৭ মার্চ ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ফ্লাইং করেছেন ১১৮ ঘণ্টার বেশি ফ্লাইং করেছেন( ৭দিন)। যা অবাস্তব।
তবে ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশনের কাছে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন জানতে চাইলে তারা বলেন, ওরিয়েন্ট এভিয়েশনে অডিট করে তারা ক্যাপ্টেন মাসুদের কোন তথ্য পায়নি। তবে ওরিয়েন্ট এভিয়েশনের তথ্যনুযায়ী বন্যায় ক্যাপ্টেন মাসুদের তথ্য গুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে ওরিয়েন্ট এভিয়েশন ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশনকে অবহিত করে, ওরিয়েন্ট এভিয়েশনে ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪৬ ঘণ্টা উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছেন। যা প্রাথমিকভাবে ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাইং করেছেন ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত পর্যন্ত( ২১দিন)।
অন্যদিকে ক্যাপ্টেন মাসুদের পাসপোর্টের কপি থেকে জানা যায়, তিনি ফিলিপাইন থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিল এবং ঢাকায় পৌঁছায় ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল।
এর আগেও বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনে অনেক বৈমানিকের জালিয়াতি ধরা পড়েছে। সম্প্রতি বৈমানিক সাদিয়া এবং মেহেদী অন্যতম উদাহরণ। এছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের লাইসেন্স শাখার কনসালটেন্স রাশেদ ঘুষ নেওয়ার সময় দুদকের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং ২ বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন। বর্তমানে তার মামলাটি চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন আল মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাবার্তাকে বলেন, এগুলো সব মিথ্যা। সিভিল এভিয়েশনে জমা দেওয়া আপনার সব তথ্য কি সঠিক এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি আরও বলেন, বিষয়টি তদন্ত চলছে। আমি কোন দুর্নীতি করিনি। ২১ দিনে কিভাবে ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাই করলেন জানতে চাইলে তিনি ফোনটি কেটে দেন।
অন্যদিকে এই বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলেন, এটি পুরোপুরি অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব। কেননা একজন বৈমানিক প্রতি মাসে কি পরিমাণ ফ্লাইং করতে পারবেন সেটারও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এখানে স্বজনপ্রীতি, লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য কিংবা দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। গত ২৩ বছরে কেন বিষয়টি কারও নজরে আসলো না সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। আমি বলতে চাই, সিভিল এভিয়েশনকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। নজরদারী বাড়াতে হবে। কেননা একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সেটার দায়ভার কিন্তু আমাদের উপরে চলে আসতো। কেননা লাইসেন্স তিনি সিভিল এভিয়েশন থেকে নিয়েছেন। কঠোর সাজা এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হলে এসব রোধ করা সম্ভব।
তবে এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বাংলাবার্তাকে বলেন, আমরা তদন্ত করেছি। কিছু অনিয়ম পাওয়া গিয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা দ্রুতই ব্যবস্থা নিবো। জালিয়াতির বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সবকিছু মিলে জালিয়াতি এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাইসেন্স প্রাপ্ত হলে মেই বৈমানিকের লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি জরিমানাও করা হবে। আমরা সম্প্রতি লাইসেন্স জালিয়াতিতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এই ক্ষেত্রেও আমরা কঠোর রয়েছি।
বাংলাবার্তা/এসজে