ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: বিদেশি বৈমানিকের অনিয়মের কারণে এবার রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হচ্ছে। বৈমানিকের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন বিমান বাংলাদেশকে এই জরিমানা করেছে। একই সাথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিদেশি বৈমানিক ক্যাপ্টেন সেরিল ভেনাসকে সাসপেন্ডও করেছে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন।
বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত বিদেশি বৈমানিকের এই অনিয়মের চিত্র।
আরও পড়ুন>> নিয়ম ভঙ্গ করে বৈমানিক ফারিয়ালের ফ্লাইট পরিচালনা
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গত বছরের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমান নিয়ে অভ্যন্তরীণ অডিট করে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন। সেই অভ্যন্তরীণ অডিটে বেরিয়ে আসে ইন্দোনেশিয়ান বৈমানিক ক্যাপ্টেন সেরিল ভেনাস এর অনিয়মের ঘটনা। ক্যাপ্টেন সেরিল ভেনাসের ইন্দোনেশিয়ান লাইসেন্স নাম্বার ১৮০১২১।মেয়াদ উত্তীর্ণ ইন্দোনেশিয়ান মেডিক্যাল সনদ নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছিলেন এই বৈমানিক। যিনি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭ এর ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আরও জানা যায়, এই বৈমানিকের ইন্দোনেশিয়ান মেডিক্যাল ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর মেয়াদ শেষ হয়। ফলে এই তারিখেই ইন্দোনেশিয়ান বৈমানিকের বিমান পরিচালনার লাইসেন্সের ক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। সবমিলে এই বিদেশি বৈমানিক ২৬ দিন মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া যতগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন প্রতিটি ফ্লাইট ছিলো অবৈধ এবং ইন্সুরেন্স আওতার বাইরে।
আরও পড়ুন>> ৩৫শ টাকা বেতনের চাকরি করে শত কোটি টাকার মালিক
বাংলাবার্তার অনুসন্ধান বলছে,বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের অনুমতিপত্র প্রদানের জন্য সিভিল এভিয়েশনের যে নির্দেশনা রয়েছে সেটার ধারা ৯.১ এবং ১০.১.৫ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন সেরিল ভেনাসের বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হলে ইন্দোনেশিয়ান মেডিক্যালের অবশ্যই মেয়াদ থাকতে হবে। অপরদিকে বাংলাদেশে বিদেশি বৈমানিকদের বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় শুধুমাত্র বিদেশি লাইসেন্সের মেয়াদ এবং লাইসেন্স সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে। যেটি সুস্পষ্টভাবে CADPAL02/2022 এর অনুচ্ছেদ ৭.১ এ I এবং অনুচ্ছেদ ১০.১.৫ এ উল্লেখ করা আছে। বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনে বিদেশি বৈমানকিদের মেডিক্যাল চেকআপ করা হয় শুধুমাত্র অনুমতিপত্র প্রদানের জন্য।
আরও পড়ুন>> যে অভিশাপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে একটি প্রজন্মকে
বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের ইন্সপেক্টর ফরিদুজ্জামান বিদেশি বৈমানিকের এই অনিয়ম নিয়ে
বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশনকে ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর একটি শোকজ করেন। সেই শোকজের জবাবে ২৫ ডিসেম্বর (২০২৩) তারিখে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালক ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনকে বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বলে শোকজের উত্তরে সিভিল এভিয়েশনকে জানান। একই সাথে বৈমানিকের ভুলের জন্য বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আরও পড়ুন>>মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে একাধিক পণ্যের চালান
তবে বাংলাদেশ বিমানের ক্ষমা প্রার্থনা করার পরও সিভিল এভিয়েশন অধিকতর একটি তদন্ত করেন। সেই তদন্তে বিদেশি বৈমানিকের অনিয়ম প্রমাণিত হয় এবং বাংলাদেশ বিমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার পাশাপাশি বৈমানিককে সাসপেন্ডও করা হয়। তবে সিভিল এভিয়েশনের আইন অনুযায়ী, অবৈধভাবে প্রতিটি ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ৯০ দিন করে সাসপেন্ড করার বিধান রয়েছে।
তবে বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা যায়, প্রায় ৪০-৫০জনের মত বিদেশি বৈমানিক বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত রয়েছে। যারা মোটা অঙ্কের বেতনভাতা পাচ্ছেন বাংলাদেশ বিমান থেকে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে এই বিদেশি বৈমানিকরা। একই সাথে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অভিজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে অবসর প্রাপ্ত বৈমানিকদের কর্মসংস্থান নষ্ট হচ্ছে এই বিদেশি অনভিজ্ঞ বৈমানিকদের জন্য।
আরও পড়ুন>>অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন বৈমানিক মাসুদ
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ বিদেশি বৈমানিকরা বাংলাদেশে খরচ করার কথা সেটা বিদেশি বৈমানিকরা খরচ করেন না। বিভিন্ন সময় জিডিতে ভ্রমণ করার সময় অবৈধভাবে বেতনের অর্থ ডলারে রূপান্তর করে নিজ দেশে নিয়ে যান বিদেশি বৈমানিকরা। এতে করে, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের সময় বাংলাদেশ সরকার এই বিদেশি বৈমানিকদের দ্বারা আরও বেশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
এছাড়া বিদেশি বৈমানিকদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঘটনও ঘটেছে বাংলাদেশ বিমানে। যেমন, সৈয়দপুরে বিদেশি বৈমানিক ল্যান্ড করার সময় রানওয়ের বাইরে চলে যান। এছাড়া সাবেক এক বিমানমন্ত্রীকে নিয়ে মাঝ আকাশে বিপদজনকভাবে বিমান পরিচালনা করার জন্য সাসপেন্ড হোন এক বিদেশি বৈমানিক।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
যদিও এই বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ বৈমানিকের অনিয়মের বিষয়টি ভুলবোঝাবোঝি বলে আখ্যায়িত করেন এবং জরিমানাও বিষয়টিও স্বীকার করেন।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাবার্তা। লিখিতভাবে যোগাযোগ করার পর বাংলাদেশ বিমানের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো, বিদেশী বৈমানিকগণের অনুকুলে সিএএবি কর্তৃক লাইসেন্সের বৈধতা (Licence Validation) ইস্যু করার পূর্বে বিমানের নিজেস্ব পাইলটগণের মতই সিএএবি-এর মনোনীত ডাক্তার দ্বারা মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। উক্ত বৈমানিকের মেডিকেল পরীক্ষার সনদ সিএএবি-এ দাখিল করার পর সিএএবি তার অনুকুলে লাইসেন্সের বৈধতা (Licence Validation) সনদ প্রদান করেন। উক্ত মেডিকেল সনদের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ফ্লাইট অপারেট করেছিলেন। পরবর্তীতে সিএএবি অবহিত করেন যে, সিএএবি প্রদত্ত মেডিকেল সনদের অতিরিক্ত ইন্দোনেশিয়ান সিভিল এভিয়েশন এরও মেডিকেল সনদ হালনাগাদ থাকতে হবে। সেই মুহূর্তে বিমান উক্ত বৈমানিকের ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রাখেন এবং অনতিবিলম্বে মেডিকেল করার জন্য তাকে ইন্দোনেশিয়া প্রেরণ করেন। এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ্য যে, তিনি মেডিকেল সার্টিফিকেট ছাড়া ফ্লাইট অপারেট করেন নাই। অর্থাৎ ২৬ দিন মেডিকেল সার্টিফিকেট ছাড়া ফ্লাইট করেছেন এমন তথ্য সঠিক নয়। তিনি সিএএবি কর্তৃক প্রদত্ত মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে ফ্লাইট অপারেট করেছিলেন।
আরও পড়ুন>>বিকাশ-নগদে নিষিদ্ধ বেটিংয়ের রমরমা ব্যবসা
বিমানকে জরিমানার বিষয়ে বিমানের বক্তব্য, এই ঘটনায় সিএএবি কর্তৃক বিমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভুল বুঝাবুঝির কারনে সিএএবি বিমানকে যে জরিমানা করেছে, তা মওকুফের জন্য বিমান গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে সিএএবি-এর নিকট আবেদন করেছে।
সিভিল অ্যাভিয়েশন এই বৈমানিককে সাসপেন্ড করেছে? বিমান তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা? নিলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান জানায়, সিএএবি-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ঐ বৈমানিককে ৬০ দিনের জন্য ফ্লাইট পরিচালনা থেকে বিরত রাখা হয়। যেহেতু বিমানের সাথে গারুদা ইন্দোনেশিয়ার দ্বিপাক্ষিক চুক্তির (জি টু জি) আওতায় ঐ বৈমানিক কর্মরত আছেন, সেহেতু তাদের নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বিষয়টি তাৎক্ষনিকভাবে গারুদা ইন্দোনেশিয়াকে অবহিত করা হয়।
আরও পড়ুন>> আইসিডি কাস্টমসের তেলেসমাতি, নিষিদ্ধ পণ্য আমেরিকাতে রফতানির অনুমতি
তবে এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলেন, সিভিল এভিয়েশনকে বৈমানিকদের এসব বিষয়ে আরও শক্ত হওয়া উচিত। সিভিল এভিয়েশন যখন বিমানকে জরিমানা করেছে সুতরাং যৌক্তিক কারণ ছাড়া জরিমানা করা সম্ভব নয়। বৈমানিকের ভুল বা অনিয়ম যেটাই হোক না সেটার জন্যই কিন্তু জরিমানা করা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের উচিত এই ধরনের বৈমানিকদের ক্ষেত্রে আরও শক্ত হওয়া। তাহলে কোন লাইন্স বা বৈমানিকরা কোন ধরনের অবৈধ সুবিধা নিতে পারবে না। বৈমানিকদের যোগ্যতার ঘটতি থাকলে অবৈধভাবে ফ্লাইট করা আসলে অন্যায় এবং অপরাধ।
বাংলাবার্তা/এসজে