ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বিদেশি বৈমানিকদের সংখ্যা এই মুহুর্তে রয়েছে ২২জন। আরও ৬জন বিদেশি বৈমানিক আনার জোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে বিমান। এই বিদেশি বৈমানিকদের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এই সাথে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ বৈমানিকরা বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু যেখানে দেশি বৈমানিকদের বিমানে বেশি কাজের সুযোগ পাওয়ার কথা সেখানে প্রতিনিয়ত তারা অবহেলিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> বিদেশি বৈমানিকের অনিয়মে নষ্ট হচ্ছে বিমানের সুনাম, গুনতে হচ্ছে জরিমানা
বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানে ৫-৬টি দেশের বিদেশি বৈমানিকরা কর্মরত রয়েছেন। যাদের বেশির ভাগ বৈমানিক ইন্দোনেশিয়ার গারুদা এয়ারলাইন্স থেকে জিটুজি এর মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশে কর্মরত রয়েছেন। আর এসব বৈমানিকদের বাসস্থান হিসেবে বিমান রেখেছে বিলাসবহুল সারিনা হোটেলে। এছাড়া বিদেশি বৈমানিকরা বছরে বাংলাদেশি বৈমানিকদের থেকে অনেক বেশি বেতনসহ ছুটি ভোগ করে থাকেন। একই সাথে বিদেশি বৈমানিকদের যাতায়াতসহ সকল আনুসাঙ্গিক খরচও বিমান বহন করে থাকে বিমান।
আরও পড়ুন>> নিয়ম ভঙ্গ করে বৈমানিক ফারিয়ালের ফ্লাইট পরিচালনা
অনুসন্ধান বলছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদেশি বৈমানিকরা নানা অনিয়ম করে আসছে। কিছুদিন আগে একজন বিদেশি বৈমানিক মেয়াদ উত্তীর্ণ মেডিক্যাল নিয়ে ফ্লাইং করার সময় বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের একজন ইন্সপেক্টটরের কাছে ধরা খান। এই ঘটনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ১০ লাখ টাকা জরিমানাও করে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন। আর বিদেশি বৈমানিককে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন থেকে ২ মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। যদিও মেয়াদ উত্তীর্ণ মেডিক্যাল নিয়ে ফ্লাই করলে আইনে প্রতিটি ফ্লাইংয়ের জন্য ৯০ দিনের জন্য সাসপেন্ড হওয়ার বিধান রয়েছে।
আরও পড়ুন>> অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন বৈমানিক মাসুদ
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) নিয়ম অনুযায়ী, যে পরিমাণ টাকা একজন বিদেশি বৈমানিকের বাংলাদেশে খরচ করার কথা সেটা তারা করছে না। বিভিন্ন সময় নন অপারেটিং ক্রু হিসেবে ভ্রমণ করে বিদেশি বৈমানিকরা নিজেদের বেতনের টাকা ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে বিমানের অপারেশন ম্যানুয়ালের যোগ্যতা অনুযায়ী কোন বাংলাদেশি বৈমানিক বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে পাওয়া না গেলে তখনই মাত্র বিদেশি বৈমানিক বিমানে আনার নিয়ম রয়েছে। এদিকে বৈমানিকদের বিভিন্ন পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিমান বাংলাদেশ এমনভাবে প্রকাশ করে থাকে যেন দেশিয় বৈমানিকরা বিমানে আবেদনই করতে না পারেন। একই সাথে বৈমানিক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি এমনভাবে বিমান দিয়ে থাকে যা বিমানের ম্যানুয়ালের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি বিমান নিয়ম মেনে বৈমানিকদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতো তাহলে বহু বাংলাদেশি অভিজ্ঞ বৈমানিক এবং বিমান বাহিনী থেকে অবসর প্রাপ্ত দক্ষ বৈমানিক পেত বিমান বাংলাদেশ। এতে করে সেবার মানউন্নয়নে বিমান বেশি এগিয়ে যেত,একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে সরকারের ওপর কম চাপ পড়তো।
আরও পড়ুন>> অনিয়মের মাধ্যমে লাইসেন্স পেয়ে ২ যুগ ধরে বৈমানিক মাসুদ
শুধু তাই নয়, যেখানে বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সগুলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নিজ দেশের নাগরিকদের বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সেখানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটে তার উল্টো চিত্র।
আরও জানা যায়, কিছুদিন আগে ড্যাস-৮ এবং ৭৩৭ বিমানে ক্যাপ্টেন হিসেবে কিছু বাংলাদেশি বৈমানিককে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর এদের প্রশিক্ষণের জন্য বেশি সময় লাগিয়ে বিমান। একই সাথে একজন দেশি বৈমানিকের প্রশিক্ষণ এবং চেক শেষ হলেও তার প্রথম ফ্লাইট পরিচালনা করতে দেওয়ার জন্য সেই বৈমানিককে ২ সপ্তাহের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন>> কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে টেকনাফে সাগর চুরি
দেশিয় অভিজ্ঞ বৈমানিকদের নিলে তাদের প্রশিক্ষণের সকল খরচ নিয়োগ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ বৈমানিকরা নিজেরাই বহন করে থাকে। ফলে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিমানের অতিরিক্ত কোন অর্থ খরচ হয় না। অন্যদিকে একজন টাইপ রেটেড অভিজ্ঞ বাংলাদেশি বৈমানিককে নিয়োগ দিলে এক সপ্তাহের (যদি কারেন্ট থাকে) ভেতরে সেই বৈমানিককে দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব। একই সাথে সেই বৈমানিকের ফ্লাইং ৫ বছরের মধ্যে থাকলে তাকে দিয়ে সবোর্চ্চ ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করানো যায়।
অপরদিকে একজন নন টাইপরেটেড অভিজ্ঞ বাংলাদেশি বৈমানিক নিয়োগ দিলে সবোর্চ্চ ২ মাস সময় লাগবে সেই বৈমানিককে দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে। অন্যদিকে বিদেশি বৈমানিককে আনতে হলে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স,ওয়ার্কিং ভিসা, ওয়ার্ক পারমিটসহ যাবতীয় অন্যান্য সকল প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ৩-৪ মাস সময় লেগে যায়। একই সাথে বাংলাদেশে আসা বিদেশি বৈমানিকদের থাকার বাসস্থানের ব্যবস্থা বিমানকেই করতে হয়। এসব বৈমানিকদের ৫ তারকা মানের হোটেলে রাখে বিমান।
আরও পড়ুন>>গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের জিএম জনসংযোগ তাহেরা খন্দকারের কাছে লিখিতভাবে প্রশ্ন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। এমনকি ফোন এবং মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি। ফলে বিমানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
যদিও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশিষ রায় চৌধুরী বাংলাবার্তাকে বলেন,আমি জিএমজি ও রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের সিওও থাকার সময় দেশি বৈমানিকদের নিয়োগের মাধ্যমে তাদের দিয়ে বিমান পরিচালনা করেছি। বিমান কেন বিদেশি পাইলট আনছে সেটা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশে প্রচুর বোয়িং ৭৩৭ বিমানের অভিজ্ঞ বৈমানিক রয়েছে। বিমান কিছু দেশিয় বৈমানিকদের ইন্টারভিউ নিলেও পরবর্তীতে তাদের আর নিয়োগ দেয়নি।আমাদের দেশে এখন বিদেশি পাইলটের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
তিনি আরও বলেন,বিমান ন্যাশনাল ক্যালিয়ার। আমরা যেটা করেছি সেটা বিমানের করা উচিত ছিলো। আমাদের অনেক লোক চাকরি ছাড়া ঘুরছে, তাদের বিমান সরাসরি নিতে পারে। এরা অভিজ্ঞ বৈমানিক।
এদিকে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার নজরুল বাংলাবার্তাকে বলেন, বিমানের অপারেশন ম্যানুয়ালে যে যোগ্যতার মাপকাঠি রয়েছে সে অনুযায়ী বিমানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বৈমানিক নিয়োগ দিলে কোন প্রশ্ন উঠবে না। কিন্তু দেশিয় অভিজ্ঞ বৈমানিক থাকার পরও বিমান কেন দেশিয়দের অগ্রাধিকার না দিয়ে বিদেশি বৈমানিক নিচ্ছে সেটার উত্তর বিমানের কাছে রয়েছে। তবে দেশিয়দের অগ্রাধিকার না দিয়ে বিদেশিদের নিলে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়।
বাংলাবার্তা/এসজে