ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞ বৈমানিকদের চরম সংকট রয়েছে। আর এই সংকট থাকায় সম্প্রতি বিমানের চিফ পাইলট প্লানিং এন্ড সিডিউল বিভাগ একটি ই-মেইলের মাধ্যমে স্বীকার করে নেয়, নিয়ম ভঙ্গ করে বৈমানিকদের দিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। তথা নিরাপত্তার বিষয়টি ভঙ্গ করে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। বিমান থেকে সিভিল এভিয়েশনে এমনই ই-মেইল দেওয়া হয়েছে। তবে এসব নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি বারবার ঘটলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে এসব কর্মকর্তারা। ফলে বারবার অনিয়ম করে পার পেয়ে যান বিমানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া বিমানের বৈমানিকরাও একটি ই-মেইল দিয়ে সিভিল এভিয়েশনকেও অবহিত করেছে।
আরও পড়ুন>> সাদিক এগ্রোর প্রায় দেড় কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ এবং ২০২৩ সালের হজ্ব মৌসুমে নিয়ম ভঙ্গ করে হজ্ব ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান। তথা নিয়ম ভঙ্গ করে বিমানের চিফ পাইলট প্লানিং এন্ড সিডিউল বিভাগ ইচ্ছাকৃতভাবে বৈমানিকদের বাধ্য করে ফ্লাইট পরিচালনা করায়। এমনকি বিমানের বৈমানিকরা বিভিন্ন সময়ে সিভিল এভিয়েশনের ইন্সপেক্টর (যিনি বিমানের জন্য নিয়োগকৃত ইন্সপেক্টর) ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামানকে বিষয়টি অবহত করলেও কোন সুফল মেলেনি।
আরও বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে, এই নিয়ম ভাঙ্গার পেছনে বিমানের চিফ পাইলট প্লানিং এন্ড সিডিউল, চিফ অব সেফটি, ট্রেনিং বিভাগের কয়েকজন বৈমানিকের সঙ্গে আতাত করে সিভিল এভিয়েশনের ইন্সপেক্টর ফরিদুজ্জামানের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। এমনকি ২০২২-২৩ সালে বিভিন্ন সময়ে সিভিল এভিয়েশনের ইন্সপেক্টররা অডিট করলেও এই নিয়ম ভঙ্গ করে বৈমানিকদের ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়টি বিস্ময়করভাবে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরও পড়ুন>> ছাগলকাণ্ডের মতিউরের ভেলকিবাজি: ছেলে ব্যবসায় বিনিয়োগ শতকোটি
এদিকে বিমান সূত্রে জানা যায়, বিমানে ২০১৮ সাল থেকে অভিজ্ঞ বৈমানিকদের অনেকগুলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও সেসব নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই প্রায় ৩০জনের অধিক বিদেশি বৈমানিক নিয়োগ দিয়েছে বিমান। যেখানে সময় মত দেশিয় অভিজ্ঞ বৈমানিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করলে নিয়ম ভঙ্গ করে অবৈধভাবে এই ফ্লাইটগুলো পরিচালনা করার কোন প্রয়োজন ছিলো না। এমনকি এই নিয়ম ভঙ্গের জন্য শুধু বিমানকে নয় সিভিল এভিয়েশন অথিরিটিকেও সমস্যায় পড়তে হবে।
আরও পড়ুন>> বারবার দুদককে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন মতিউর রহমান
কারণ সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে একটি ই-মেইলের মাধ্যমে বিমানের বৈমানিকরা জানিয়েছেন, বিমানের এই অনিয়মের বিষয়টি যদি সিভিল এভিয়েশন অথরিটি কোন আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয় তাহলে বিষয়টি তারা আইকাউ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ এয়ার লাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন (আইফালফা) কে জানাবে।
এদিকে বিমানের বৈমানিকরা বলছেন, আইনগতভাবে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না করে আরেকটি নিয়োগ প্রক্রিয়াতে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিস্ময়করভাবে বিগত সরকারের আমলে কার স্বার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে দেশিয় বৈমানিকদের নিয়োগ না দিয়ে বিদেশি বৈমানিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটা তারা জানেন না। এসব নিয়োগ প্রক্রিয়াতে যারা যারা সম্পৃক্ত ছিলেন সবার বিষয়ে তদন্ত চান বিমানের বৈমানিকরা। আর এসব নিয়োগের কারণে খোদ বিমানের ভেতরেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিমানের বিভিন্ন উড়োজাহাজে প্রায় ৩০জনের মত বিদেশি বৈমানিক রয়েছে। যার অধিকাংশ ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা।
আরও পড়ুন>> মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর নামে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার পাচার
এদিকে বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈমানিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিমানের চিফ পাইলট প্লানিং এন্ড সিডিউল বিভাগের প্রধান তার নিজের সন্তানকে বিমানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাজটি অসম্পন্ন করে রেখেছেন। যার কারণে বিমানের গত সরকারের আমলে সম্প্রতি একটি ক্যাডেট পাইলটের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তড়িঘড়ি করে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। যদিও অভিজ্ঞ বৈমানিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি কেন ঝুলে আছে সেটা বিমানের কেউ-ই কোন সদুত্তর দিতে পারছেন না। এছাড়া অভিজ্ঞ বৈমানিকদের এই শূণ্যস্থানে কখনোই স্বল্প অভিজ্ঞ ক্যাডেট পাইলট দিয়ে পূরণ করা সম্ভব না। এটি একটি ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘ ১০-১২ বছর মেয়াদী একটি প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন>> কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে টেকনাফে সাগর চুরি
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বিমানে বৈমানিক স্বল্পতা থাকার পরও নিয়মভঙ্গ করে ড্যাশ-৮ থেকে ৭৩৭ উড়োজাহাজে বিমানের ২ বৈমানিককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই দুইজন বৈমানিকদের সঙ্গে বিমানের বর্তমান উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের গভীর সখ্যতা থাকায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি পাওয়া এই ২ বৈমানিকের একজন একজনের স্ত্রী বিমানের উর্দ্ধতন বৈমানিক। এছাড়া আরেকজন ৭৮৭ উড়োজাহাজের ফার্স্ট অফিসার থেকে ৭৩৭ উড়োজাহাজে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এই বৈমানিক ২০২১ সালে এটিপিএল পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে সিভিল এভিয়েশনের কাছে ধরা পড়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে ১ বছরের জন্য বহিঃষ্কার করে। তবুও অদৃশ্যক্ষমতাবলে তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন।
আরও পড়ুন>>গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি
বাংলাবার্তার অনুসন্ধান আরও বলছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বৈমানিক হিসেবে কর্মরত রয়েছে এমন একাধিক বৈমানিক সিভিল এভিয়েশনে শিক্ষাগত যোগ্যতার নূন্যতম মানদন্ড পূরণ করতে পারেনি। এমন ৩জন রয়েছে যারা জিইডি পাশ করা। তবে এসব বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন যেন বরাবরের মতোই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। অপরদিকে সম্প্রতি বিমান ক্যাডেট বৈমানিক নিয়োগের জন্য একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তবে এই ক্যাডেট বৈমানিক নিয়োগে বয়স সীমা ৪০ পর্যন্ত শিথিল করলেও নিয়োগ পাওয়ার পর এসব বৈমানিকদের কোন পদে পদায়ন করা হবে সেটা উল্লেখ করা নেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। এমনকি আগের ক্যাডেট বৈমানিক নিয়োগে অনেক অভিজ্ঞ বৈমানিক নিয়োগ পেলেও নিয়োগ পরবর্তী সময়ে তাদের এই অভিজ্ঞতা গুরুত্ব দেয়নি বিমান।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, আগের ক্যাডেট বৈমানিক নিয়োগে একজন ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজের প্রশিক্ষক ক্যাডেট বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হলেও তাকে ড্যাশ-৮ বিমানের ফার্স্ট অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করতে হয়। এছাড়া ক্রমিক নম্বর আসে ১৫০ ঘণ্টা ফ্লাইং করা অনভিজ্ঞ বৈমানিকদেরও পরে। ফলে বিগত সরকারের আমলে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে করা হয়েছে নানা অনিয়ম।
যদিও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলছেন, এটা মোটও যুক্তিসঙ্গত নয়। গুরুতর অভিযোগ এটি। তদন্ত হওয়া উচিত। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কেননা যাত্রীদের নিরাপত্তাও জড়িত এখানে। সিভিল এভিয়েশন এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া এবং নানা অনিয়মের কারণে ক্যাটাগরি ১ এ যেতে পারছে না। যার কারণে বিভিন্ন দেশে আমাদের ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
সিভিল এভিয়েশনের দায় দয়িত্ব রয়েছে। তাদের উচিত সুষ্ঠু তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা যেন সামনে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটতে না পারে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বাংলাবার্তাকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। তবে জেনে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো। এই মুহুর্তে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো.মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বাংলাবার্তাকে বলেন, আমি নতুন জয়েন করেছি। বিষয়গুলো আমি পর্যবেক্ষণ করবো এবং চেষ্টা করবো কাজ করতে। অনিয়ম পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে এ বিষয়ে জানতে বিমানের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে বাংলাবার্তার পক্ষে থেকে একাধিকবার কল করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এই বিষয়ে তার কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাবার্তা/এআর