ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: আরজিনা খাতুন ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি কাস্টমস এন্ড এক্সাইজ ক্যাডারে যোগদান করেন। এরপর তার চাকরি স্থায়ী হয় ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর। অতপর এই শুল্ক ক্যাডারের ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই কর্মকর্তার উত্থান মূলত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, সোনার অলংকার সবই করেছেন এই শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তা।
আরজিনা খাতুন বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয়) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
আরও পড়ুন>> সাদিক এগ্রোর প্রায় দেড় কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি
গত ১০ জুন আরজিনার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের খতিয়ান তুলে ধরে দুদকে অভিযোগ জমা দেন এক ব্যক্তি। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার ছিলেন।
অতপর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সাবেক এই ডিসি আরজিনা খাতুনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতে করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আরও পড়ুন>> ছাগলকাণ্ডের মতিউরের ভেলকিবাজি: ছেলে ব্যবসায় বিনিয়োগ শতকোটি
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বাংলাবার্তাকে বলেন, চাকরিজীবনে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অসদাচরণ, ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর কমিশনের নির্দেশে অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। বাকিটা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। সাধারণত মেরিট না থাকলে অনুসন্ধান করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয় এখানে দুর্নীতি হয়েছে। বাকিটা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে।
যদিও এ বিষয়ে একাধিকবার এনবিআরে কর্মরত এই শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তার অফিসে বক্তব্য চাওয়ার জন্য গেলে তিনি কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এমনকি আরজিনার মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন এবং মেসেজ দেওয়া হলেও তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন>> বারবার দুদককে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন মতিউর রহমান
এদিকে দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, আলোচিত সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে গভীর সুসর্ম্পক ছিলো এই আরজিনা। আর এই মতিউর রহমানের স্পর্শে বিভিন্ন উপায়ে ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জন করেছেন তিনি।
আরও বলা হয়েছে, আরজিনা খাতুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত থাকাকালীন আমদানি পণ্য খালাসের নামে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। অনেক সময় পণ্য খালাসের কাজ না হলেও ফেরত দিতেন না ঘুষের টাকা। এভাবে দুর্নীতির টাকায় তিনি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একইসঙ্গে তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে হাতিয়েছেন প্রায় ছয় কোটি টাকার স্বর্ণ।
আরও পড়ুন>> মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর নামে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার পাচার
দুদক সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থে ৫০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা খাতুন। তার বার্ষিক আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের সময় ১০০ ভরি স্বর্ণ উপহার পেয়েছেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার বিয়ের কাবিননামায় এসব স্বর্ণের কথা কোন কথা উল্লেখ নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গ্রামে আলিশান বাড়ি, পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। মাত্র তিন বছরে আরজিনা কিনেছেন অন্তত ৫০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, যার ২০০ ভরি চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন>> কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে টেকনাফে সাগর চুরি
অভিযোগে বলা হয়েছে, ক্রয়মূল্য গোপন করে ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন এই কাস্টমস কর্মকর্তা আরজিনা খাতুন। ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ২ কোটি টাকায়। কিন্তু কেনার চুক্তিনামায় উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া ফ্ল্যাট কেনার পর সেখানে ইনটেরিয়র ডিজাইনের পেছনে খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা। ফ্ল্যাটের ইলেক্ট্রনিক্স ও ফার্নিচারের পেছনে ব্যয় ৩৫ লাখ টাকা। তবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ফ্ল্যাট কেনার এক বছর পর।
কাস্টমসের চাকরির আগে আরজিনা খাতুনের বাড়ি ছিল ২০ ফিটের টিনের ঘর। ওই টিনের ঘরের একটি অংশটি পাটিশন দেওয়া ছিল। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়িতে ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। ফার্নিচার ও ইলেক্ট্রনিক্স ব্যয় করা হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি ডিভোর্স হয়েছে এই শুল্ক কর্মকর্তার। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া এবং বাইরে যাতায়াতকেই দুষছেন ঘনিষ্ঠজনরা। তবে আরজিনার এতসব দুর্নীতি কিভাবে সামনে এলো সেটা নিয়ে খোদ এনবিআর কর্মকর্তারাই দ্বিধাদ্বন্ধে পড়েছেন। তবে একটি গোপন সূত্রে জানা গিয়েছে, আরজিনার খুবই ঘনিষ্ঠজন দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। যার কারণে অভিযোগ দ্রুত আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
আরও পড়ুন>>গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি
যদিও এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বাংলাবার্তাকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে দুদক যেকোন ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারে। আমি যেহেতু জানলাম সুতরাং আমরাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো। প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষায় কোন দুর্নীতিবাজকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। আপনারা(গণমাধ্যম) দুর্নীতির তথ্য দিন আমরা ব্যবস্থা নিবো।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই ধরণের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধানের আগে তাদেরকে এনবিআরের উচিত চাকরিচ্যুত করা। তাহলে এ ধরণের দুর্নীতি করা মাত্রা অন্যান্য কর্তকর্তাদের মধ্যে কমে আসবে। এনবিআরের এখনি সময় তাদের সুনাম রক্ষা করা। এনবিআরের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করায় হবে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা করা।
বাংলাবার্তা/এআর