ছবি: বাংলাবার্তা
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান দুর্নীতি করে নিজেকে দুর্নীতির গডফাদার বনে গিয়েছেন। এই বিভাগে যুক্ত হওয়ার পর তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মকে নিজের আদর্শ করেছেন। যেখানে টাকা ছাড়া নড়ে না কোনো ফাইল। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিআরডি) সচিব হিসেবে কর্মরত।
এই সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মূখ্য সচিব বরাবর একটি আবেদন জানায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন কর্মী যার নাম এবিএম মইনুল হোসেন। একই সাথে তিনি অনুলিপি দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী,সিনিয়র সচিব, মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব। তবে বিস্ময়করভাবে এই দুর্নীতির অনুসন্ধান কোন সংস্থা করেনি কিংবা তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে নিজের চেয়ারে বসে দিনের পর দিন দুর্নীতি করে গিয়েছেন আর সরকারের কোটি কোটি টাকা কমিশন খেয়ে নিজের পকেট ভরেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, তার নেতৃত্বে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে গঠিত হয়েছিল একটি সিন্ডিকেট চক্র। আর এই চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন, মাহবুব আলম, উপসচিব আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও যুগ্মসচিব ড. মো. তৈয়বুর রহমান। এই সিন্ডিকেট চক্র টাকার বিনিময়ে অযোগ্য কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি দিতেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সারাদেশে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবার জন্য সরকার “অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক” নামক প্রকল্প হাতে নেয়, যার আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের ইন্টারনেট চাহিদা মেটানোর উপযোগী অবকাঠামো তৈরী করা হবে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় Nokia, ZTE, Huawei অংশ গ্রহণ করে এবং সবাই গ্রহণযোগ্য হয়। বিটিসিএলে বর্তমানে সি (C) ব্যান্ড টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে (সি++) C++ বা সুপার সি (C) ব্যান্ড টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে। প্রকল্প পরিচালক মনজির আহমেদ এবং মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম উক্ত কোম্পানী গুলো থেকে একটি কোম্পানীর সাথে নিম্নমানের পুরনো প্রযুক্তি সি (C) ব্যান্ড দিয়ে কাজ দেওয়ার আশ্বাস দিলে ZTE নামক একটি কোম্পানী মন্ত্রী বরাবর অভিযোগ করে । ফলশ্রুতিতে প্রযুক্তি ফাঁকির বিষয়টি সামনে আসে এবং মন্ত্রী বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রযুক্তির বিষয়টি পুনঃ নিরীক্ষণের নির্দেশনা দেন।
যেখানে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড আর্থিক সংকটের কারণে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না সেখানে টেলিটককে জোর করে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের পুনর্মীলনীতে দশ লাখ টাকা খরচ করে স্টল বানিয়ে বই বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, ডাক অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে হারুন-অর-রশিদ দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। হারুন-অর রশিদকে চলতি দায়িত্ব দেওয়ায় ফাইলগুলো দপ্তরে আটকে আছে সাড়ে ৫ মাস ধরে। কারণ হারুন-অর-রশিদ তার চাহিদা পূরণ করতে পারেননি তাই তিনি সামছুল আলম নামে অন্য একজনকে উক্ত পদে দায়িত্ব দিতে চান। অথচ সামছুল আলম এখনও অতিরিক্ত মহাপরিচালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। সামছুল আলমের দুর্নীতির কারণে ডাক অধিদপ্তরের ২০ জন কর্মকর্তাকে কারাগারে যেতে হয় এবং ৫ জন কারাগারে আত্মহত্যা করেন। যারা কারাগারে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।তারা হলেন, কলারোয়া উপজেলা পোস্টমাস্টার মীর আবদুল হক, প্যাকার হাবিবুর রহমান, পোস্টম্যান গাজী ফজলুর রহমান, উপজেলা পোস্টমাস্টার আউব আলী সরদার, কেশবপুর-মনিরামপুর উপজেলা পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নান আকুঞ্জী।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিটিআরসি থেকে প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ২জি সেলুলার মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স বাতিলের পূর্বানুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি দেয় । ডেস্ক অফিসার সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ এবং ১১০ ধারা মোতাবেক “আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা” অর্পণ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়টি কোন পর্যায়ে নিষ্পত্তিযোগ্য তার নথিতে উল্লেখ করার পরেও তিনি নথিতে মন্ত্রী পর্যায়ে নিস্পত্তি যোগ্য উল্লেখ থাকার পরেও নথিতে অনুমোদনসহ স্বাক্ষর করে নিচে নামিয়ে দেন।
গত ৬ মাস বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ড সভায় যেসব দরপত্রে কাজ অনুমোদন দিয়েছেন, তার মধ্যে বেশিরভাগ দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ পায়নি। সর্বনিম্ন দরদাতাকে ছলেবলে নন রেসপনসিভ করে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা বেশি কমিশন দেবে না। যে কোম্পানি তার লোকের কাছে এসে বেশি কমিশনের কথা বলেছে সেই কোম্পানিই কাজের জন্য মনোনীত হয়েছে। বিটিসিএল’র আইসিএক্স এর দরপত্রের কাজের জন্য গত ৩০ মার্চের বোর্ড সভায় সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেন তিনি। অথচ এর আগে সর্বনিম্ন দরদাতা মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান চৌধুরী অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় তার বরাবর অভিযোগ জমা দিলেও তা আমলে নেননি। যার ফলে সরকারের ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা লোকসান করে আসাদুজ্জমান চৌধুরীর মনোনীত দরদাতাকে (Digital Services Ltd.) কাজ দেওয়া হয়েছে। একারণে সরকার বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে টেলিটক ৪জি প্রজেক্টের এন্টেনা দরপত্রেও সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় সর্বনিম্ন দরদাতা অভিযোগ দিতে গেলে তাকে ভৎসনা করা হয়। ৪টি লট মিলে এই কাজে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর এইভাবে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আয় করে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক মস্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাবার্তাকে বলেন, "মন্ত্রী হিসাবে আমার মেয়াদকালে, আমি সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছি। যখন তিনি (আবু হেনা) ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেন। আমি একাধিকবার পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে তার দুর্নীতি সম্পর্কে জানিয়েছি কিন্তু কোনোভাবে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তার পদ রক্ষা করেছেন।"
"আমাদের এডিপি মিটিংয়ের সময়, আমরা তাকে (আবু হেনা) ৫জি যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন পুনরায় পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলাম, কারণ সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি এবং নিজের ইচ্ছামত কাজ করেছেন," জানান এই সাবেক মন্ত্রী।
এই বিষয়ে জানতে সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে বাংলাবার্তার পক্ষ থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে এই বিষয়ে তার কোন বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাবার্তাকে বলেন, এতগুলো সংস্থাকে জানানো হলো কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নিলো না এটা আশ্চর্যজনক। একই সাথে অভিযোগগুলোর বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না সেটার বিষয়ে এখন তদন্ত করা প্রয়োজন। কেননা কারা এটার সাথে সম্পৃক্ত সেটা বের করা জরুরি। এই সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন উচিত জরুরি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। অপরদিকে দুর্নীতির দায়ে অন্য যারা সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এই সরকারের উচিত যেকোন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলা।
বাংলাবার্তা/এআর