ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: পর্যাপ্ত জনবল এবং দীর্ঘদিন ধরে ফাইল পড়ে থাকা, স্বনামধন্য ব্যক্তিরা নজরদারির বাইরে থাকায় তাদের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে রীতিমত বিপাকে পড়তে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরকে। তবুও এনবিআর মনে করছে, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তদন্তে এগিয়ে যাচ্ছে এনবিআর।
বন্দর নগরী চট্টগামের আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। এস আলম গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠাতা এস আলম নামেই পরিচিত। ব্যবসা ও কর্মসংস্থান তৈরি করে এই উদ্যোক্তা যতটা না আলোচিত, তারচেয়ে বেশি সমালোচিত ব্যাংক দখল, অর্থপাচার, কর ফাঁকিসহ নানা অভিযোগে। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এই ব্যবসায়ী রাজনীতিতে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেন যে, তার বিরুদ্ধে বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত থামিয়ে দেয় আদালত।
শুধু কি তাই, ব্যাংক দখল, খেলাপি ঋণ কোনো অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে শেখ হাসিনার পলায়নের পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। এস আলমের অনিয়ম তদন্তে তৎপর হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরই মধ্যে এস আলম পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। তার ও পরিবারের সদস্যদের ঋণের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। সরকার পতনের পর এস আলম পরিবারের বিরুদ্ধে প্রথম তদন্তের উদ্যোগ নেয় এনবিআরের কর অঞ্চল ১৫। সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দপ্তরটি।
এবার সাইফুল আলমের কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট এলটিইউ-ট্যাক্স। এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম এলতিইউ শাখায় চিঠি দিয়েছেন এলটিইউ কমিশনার। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত তার ও কোম্পানির ছয় বছরের সকল লেনদেন খতিয়ে দেখা হবে। এ তদন্ত করবেন এলটিইউ ট্যাক্সের চট্টগ্রাম শাখার উপ কর কমিশনার আওরঙ্গজেব খান।
অপরদিকে জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। নিয়োগ-টেন্ডার বাণিজ্য, ভুমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার নানা কারণে ব্যাপক সমালোচিত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাক্তার জাহিদ মালেক। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে মানিকগঞ্জের এই সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে তার ও পরিবারের সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এবার জাহিদ মালেকের কর ফাঁকির অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইসি। এরই মধ্যে জাহিদ মালেকের কর নথি সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। জাহিদ মালেক বৃহৎ করদাতা ইউনিট এলটিইউ ট্যাক্সের নিবন্ধিত করদাতা। সম্প্রতি এই দপ্তর থেকে তার আয়কর নথি তলব করেন সিআইসি গোয়েন্দারা।
অন্যদিকে গত সপ্তাহে দেশের শীর্ষ পাঁচ শিল্পগ্রুপের মালিকের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে সিআইসি। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি’র চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও সামিট গ্রুপের আব্দুল আজিজ খানের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি এসব শিল্প উদ্যোক্তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থাৎ পরিবারের সদস্য এবং কোম্পানির লেনদেনের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। এক এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর এবারই টাইকুনদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির তদন্ত শুরু হল। তালিকায় আরও ৩৫ জন কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। এদের মধ্যে গত দেড় দশকে যাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের তদন্ত হয়নি, একে একে তাদের সবাইকে আওতায় আনতে চায় সিআইসি। সরকারের ঘনিষ্ট হিসেবে কাজ করেছেন ও প্রচুর বিত্তের মালিক হয়েছেন এমন ব্যক্তিরাই আছেন তালিকায়।
সিআইসির কর্মকর্তারা জানান, গণমাধ্যম ও গোয়েন্দাসূত্রের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় আছেন রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তবে তদন্ত করতে গিয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে সিআইসি গোয়েন্দাদের। এত অধিক সংখ্যক নথি পর্যালোচনার পর্যাপ্ত লোকবল নেই দপ্তরে। দীর্ঘদিন সুশাসন না থাকায় ও সরকার ঘনিষ্ঠ লোকজন অপকর্মে লিপ্ত থাকায়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গোয়েন্দা দপ্তরগুলোকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ডক্টর মুস্তাফিজুর রহমান।তিনি বাংলাবার্তাকে বলেন, দপ্তরগুলোতে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণ বাড়ানোরও প্রয়োজন।
যদিও এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগের মানবসম্পদ বিষয়ক সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ বলেন, সিআইসিকে আমরা সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সেখানে জনবলের যে ঘাটতি আছে, অবিলম্বে চাহিদাপত্র নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূরণ করা হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে