ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: বিমান বাংলাদেশের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) নওশাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও নিজ স্বার্থে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগে সুপারিশ ও অদক্ষ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি বিমানের টাকা সরকারি ব্যাংকে না রেখে অনিয়ম করে সেই অর্থ বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতেন। এছাড়া ফারমার্স ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা রাখেন। পরে ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ায় আর সেই টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন>> বারবার দুদককে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন মতিউর রহমান
অনুসন্ধানে জানা যায়, নওশাদ হোসেনের জন্য বিদেশে ৫ লাখ ডলার ত্রুটির কারণে বিদেশি অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। তিনি আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি করেছিলেন। এই টাকা এখনো উদ্ধার হয়নি। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হবে কিনা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সেটা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে বিমানের অভ্যন্তরে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এই কর্মকর্তা অনিয়মের মাধ্যমে নিজের আত্মীয়- স্বজনদের বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি দিতেন। তিনি ও তার স্বেচ্ছাচারীতার সহযোগী মনঞ্জুর ইমাম অবৈধভাবে সাউথ-বাংলা ব্যাংকে ১০ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকে ১৬১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ২০০ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকে ৮১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১০ কোটি এবং ফারমার্স ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত হিসাবে রেখেছেন। ফারমার্স ব্যাংক দেওয়ালি হওয়ায় সেই টাকা আর পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানা গিয়েছে। বিমানের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে বিপাকে রয়েছে। অন্যদিকে যেখানে সরকারি ব্যাংকের সুদের হার ৯.৫। সেখানে ৭.৫ এ আমানত রেখেছেন তিনি এবং বিমান ২ শতাংশ হারে বিপুল পরিমান মুনাফা হারাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর নামে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার পাচার
নওশাদ প্রয়োজনীয় অনুমোদন না নিয়ে অত্যন্ত কম সুদের ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে বিমানের অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রেখেছেন, যার ফলে বিমানের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলো স্থায়ী আমানতের জন্য আদর্শ সুদের হার ৯.৫ শতাংশ। বিমানের তহবিল পরিচালনার জন্য একজন কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও নওশাদ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত তার আত্মীয়দের সুবিধার জন্য তহবিলের নিয়ন্ত্রণ নেন।
বিমানের এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, নওশাদ আইসিটি বিভাগের উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং ১১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বদলির আদেশ জারি করা হয়েছে। তবে তিনি এখনও বিমানে তার অফিসিয়াল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো বিমানের ওয়েবসাইটে তার ছবি সম্বলিত পদ উল্লেখ করা আছে।
আরও পড়ুন>> কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে টেকনাফে সাগর চুরি
এদিকে এই কর্মকর্তার গাফিলতিতে ৫ লাখ ডলার হারাতে বসেছে বিমান। তিনি বিমান অফিস থেকে ৫ লাখ ডলারের ইস্যু উধাও করার চেষ্টাও করছেন, যেটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বদলির আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও নওশাদ সিএফও হিসেবে তার পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
বিমানের গত বছরের ৬ জুনের একটি গোপন নথি থেকে জানা যায়, এই কর্মকর্তা গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরের সোনালী ব্যাংকের শাখায় পরিচালিত ফরেন ক্যারেন্সি একাউন্ট নং- ০১২৮৯০৭০০০০০১ এর মাধ্যমে ৫ লাখ ইউএস ডলার পাঠাতে ইরান এয়ারপোর্ট এয়ার নেভিগেশন কোম্পানি এবং এমিরেটস জেনারেল পেট্রোলিয়ামের ইনভয়েস ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, লেনদেনটি সম্পন্ন হয়নি।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
সোনালী ব্যাংক হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাখার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ইরানের উপর ইউএস ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞা আছে বিধায় লেনদেনটি সম্পন্ন হয়নি এবং ইউএস ডলার ৫ লাখ সমপরিমান অর্থ তাদের নষ্ট হিসাবে জমা আছে। এরপর বিমানের পক্ষ থেকে নানা চিঠি চালাচালি করা হলেও সমুদয় অর্থ আর ফেরত পাওয়া যায়নি। প্রায় দেড় বছর ধরে এই অর্থ বিদেশে আটকে আছে। কবে পাওয়া যাবে কিংবা আদতে পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়েও চিন্তিত বিমান।
বিমান সূত্রে আরও জানা যায়, সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া বিমানের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করে সিএফও নওশাদ হোসেন বিমানে তার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বিমানের বৈষম্য বিরোধী কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন>>গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি
আরও জানা গিয়েছে, নওশাদ, আবু সাইদ মো. মনজুর ইমামকে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন, যিনি রাজস্বের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এফএমআইএস পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। যেখানে তিনি সংস্থার পরিচালনার সততার সাথে আপস করেছিলেন।
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধান বলছে, বিমানের অর্থ বিভাগের পরিচালক পদটি একটি বিশেষায়িত পদ, এই পদে নিয়োগ পেতে হলে বাণিজ্য বিভাগ হতে স্নাতকোত্তর পাশসহ প্রফেশনাল ডিগ্রি এবং অর্থ-হিসাব সংক্রান্ত ১৫ থেকে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বর্তমানে নিয়োজিত বিমানের অর্থ বিভাগের পরিচালক প্রাণী বিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং এয়ারলাইন্স অথবা পেশাদারী হিসাব বিজ্ঞানের কোন অভিজ্ঞতাই তার নাই। তথাপি শুধুমাত্র হাসিনা সরকারের মদদপুষ্টের কারণে তাকে মন্ত্রণালয় হতে বিমানে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ও যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তিনি বিমানের অর্থ বিভাগকে একটি নাজুক ও ভঙ্গুর বিভাগে পরিণত করেন।
আরও পড়ুন>> সাদিক এগ্রোর প্রায় দেড় কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি
এদিকে বিমানের কর্মকর্তারা বলছেন, তার একক স্বেচ্ছাচারীতা, স্বৈরাচারী আচরনের জন্য বিমান ক্রমশ অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। তার স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে অন্য বিভাগ থেকে তার নিজের লোকদের অবৈধ ভাবে অর্থ বিভাগে বদলীর জন্য বারবার চেষ্টা করেন তিনি। পে- গ্রুপ ৩ (২) তে জনবল না থাকা সত্বেও তিনি বারবার অতি উৎসাহী হয়ে সরাসরি অফিসার নিয়োগ করেন।যেখানে তার নিয়োগ বাণিজ্য ছিলো আছে। এভাবে তিনি পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মচারীদের উপর দমন ও পেশন প্রক্রিয়া চালু করেন। তিনি তার স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিমান নারিতা স্টেশনে গ্রুপ ৭ এর পদে গ্রুপ-৮ এর কর্মকর্তা প্রেরন করেন, যা বৈদেশিক পোস্টিংয়ের সেট আপে নাই এবং বাংলাদেশ বিমানে কান্ট্রি ম্যানেজারের (গ্রুপ-৭) চেয়ে ফিন্যান্স ম্যানেজার এর উচ্চতর পদ (গ্রুপ-৮) অন্য কোথাও নাই।যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং নজিরবিহীন, নির্দিস্ট সময়ের মধ্যে ফরেন পোস্টিং এর ফলাফল প্রকাশ না করে পছন্দের কর্মকর্তা কে সুযোগ দেয়ার জন্য ৬ মাস পরে বিমান লন্ডন স্টেশনের ফলাফল প্রকাশ করেন এবং অবৈধ ভাবে নতুন পদ সৃষ্টি করে তাকে পদায়ন করেন।
আরও জানা যায়, নওশাদ হোসেনের স্বেচ্ছাচারীতার কারণে অর্থ বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে গিয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্ট উপ-বিভাগের জিএম, ডিজিএম কে বাদ দিয়ে তার পছন্দের নিম্নপদস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য দায়িত্ব প্রদান করতেন এবং তার আদেশ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন, ফলে অর্থ বিভাগের চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তিনি আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ কর্মচারীদের নিকট মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার তথ্য সংগ্রহ করে উক্ত তথ্য যাচাই বাছাই না করে কর্মকর্তা কর্মচারীদের হেনস্তা করার জন্য শো-কজ, চার্জ মীট প্রদান করে দমন নিপীড়ন চালু করেন। এতে বিমানের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে বলে দাবি বিমান কর্মকর্তাদের। এছাড়া তিনি বিমানের বিভিন্ন স্টেশনে পোস্টিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট সে-গ্রুপ না রেখে দ্বৈত গ্রুপ রাখার নিয়ম চালু রেখেছেন যাতে তার পছন্দের ব্যক্তিকে পোস্টিং দিতে পারেন।
পে-গ্রুপ ৬ এ অভ্যন্তরীন কর্মীদের প্রমোশন বন্ধ রেখে নিয়োগ বানিজ্য করার জন্য সরাসরি পে-গ্রুপ ৬ এ নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করেন, এতে অভ্যন্তরীন কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
এই বিষয়ে নওশাদ হোসেন বাংলাবার্তাকে বলেন, বিমানের যেকোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এমডি ও সিইও এর কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়। ৩১১তম বিমান বোর্ডের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বোর্ড এতে কোনো সমস্যা খুঁজে পায়নি। সব প্রমাণ দেখানোর জন্য প্রস্তুত। অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীল নথিপত্র ফাঁস করে দুর্বৃত্তরা বিমান ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
তবে এই কর্মকর্তা বিমানের অন্য একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দিয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার অফিসে আমন্ত্রণ জানান। একই সাথে নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাবার্তাকে বলেন, বিমানের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। তাই সংশ্লিষ্ঠদের উচিত তদন্ত করে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া। সরকারের টাকা এভাবে নষ্ট হতে পারে না। আমরা আশা করি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সচেষ্ট হবে।
নওশাদের দুর্নীতি এবং সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক এমডি সম্প্রতি ওএসডি হওয়া কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম ভূঞার সঙ্গে, তবে তার ফোনটি রিসিভ করেননি।
এদিকে বিমানের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে বাংলাবার্তার পক্ষে থেকে একাধিকবার কল করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এই বিষয়ে তার কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাবার্তা/এসজে