ছবি: বাংলাবার্তা
দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি ডায়মন্ড ওয়াল্ডের কর্ণধর। নানা অপকর্ম আর সোনা চোরাচালানের মূল হোতা হিসেবে যার নাম উঠে এসেছে একাধিকবার। দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগে অভিযোগ পড়ে। কিন্তু ক্ষমতা আর অর্থের প্রভাবে দুদককে ফাঁকি দিয়ে পেয়ে যান ক্লিন সার্টিফিকেট। তবে এবার নতুন করে আবার অনুসন্ধান হচ্ছে এই ব্যবসায়ীর। একই সাথে তিনি ছিলেন, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
সম্প্রতি দিলীপ কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি ডায়মন্ডের নামে বিশেষ এক ধরনের কাঁচ বিক্রি করে ক্রেতার সাথে প্রতারণা করেছেন। আমদানি না করেও দেড় দশক ধরে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ২৮টি শোরুমে ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রি করছেন তিনি। মোজানাইট কিংবা জারকান পাথর মূলত এক ধরনের কাঁচ, যা বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি হওয়ায় দীর্ঘ সময় চকচকে দেখায়। এই বিষয়ে অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে আসল সত্যতা।
দুদকের একাধিক সূত্র জানায়, অভিযোগটি কমিশনে এলে দুদকের যাচাই বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়। যাচাই বাছাই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে অভিযোগটি আবার কমিশনে উঠবে। এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে পূণরায় অনুসন্ধান হবে কি না! তবে দুদকের একাধিক উর্দ্ধতন সূত্র বলছে, ফাইলটি আবার অনুসন্ধান হবে। কেননা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেরিট থাকলেও তখন সেগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। এমনকি বিগত সরকারের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের চাপও থাকতে হবে। আগের দুদক আর এখনকার দুদকের মধ্যে অনেক ফারাক রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগ থেকে দিলীপ কুমার আগারওয়ালকে অব্যাহতি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দীর্ঘ প্রায় তিন বছর তদন্ত শেষে আগারওয়ালকে দায়মুক্তি দেয়া হয় তখন। দায়মুক্তির ওই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর দিলীপ কুমার আগারওয়ালের বিরুদ্ধে সংস্থাটির প্রধান কাযালয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে অভিযোগ ছিল, স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে দিলিপ আগারওয়াল রাজস্ব ফাঁকিসহ শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
তখন অভিযোগ পেয়ে কমিশন থেকে তিন কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয় দুদক। অনুসন্ধানের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ছিলেন, দুদক উপপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন মৃধা, সহকারী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান শিকদার ও উপসহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান। অনুসন্ধানকাজ তদারক করেন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ বাংলাবার্তাকে বলেন, আমরা কোন দুর্নীতি বরদাশত করবো না। যারা সকল দুর্নীতি করেছে তাদের কোন ছাড় দেওয়া হবে না। নিস্তার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কাউকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিলেও যদি কমিশন মনে করে আবার অনুসন্ধান করা প্রয়োজন তাহলে সেটা করা হবে। আমরা কমিশনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।
দিলীপ কুমার আগারওয়ালের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন মৃধা সম্প্রতি পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান। দুদকে আসা অভিযোগে মৃধার দেয়া দায়মুক্তির প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে কমিশনে। দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়, অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন মৃধা দিলীপ কুমার আগারওয়ালকে রক্ষা করতে ফরমায়েশি প্রতিবেদন দিয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় ফাইলটি নিষ্পত্তি হয়েছে তাতে দুদকের অনুসন্ধানের যে বিধি, সম্পদ যাছাইয়ের যে প্রক্রিয়া তা যথাযথ হয়নি। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের হীরার মানও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়নি। দুবাই, কানাডা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মাফিয়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্যতাও খতিয়ে দেখা হয়নি। দেশের বাইরে তার বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকলেও তা খতিয়ে দেখা হয়নি। তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিপুল সম্পদের উৎস কি তার ধারে কাছেও যাওয়া হয়নি।
অভিযোগেে আরও বলা হয়েছে, মূল অভিযোগের কোনো অনুসন্ধান না করে, আগারওয়ালের শুধু আয়কর নথি দেখে তার পক্ষে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে কোনো পরিদর্শন করেননি।দিলীপ কুমার আগারওয়ালকে দায়মুক্তি দেয়া দুদকের ফাইলটি পড়া হলে বুঝা যাবে কেমন ফরমায়েশি দায়মুক্তি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
এদিকে দিলীপ কুমার আগারওয়াল আওয়ামী লীগের সবশেষ দুই কমিটির উপ কমিটিতে শিল্প বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য ছিলেন। ওবায়দুল কাদের ও সালমান এফ রহমানকে ম্যানেজ করে তিনি উপ কমিটিতে জায়গা করে নেন। এছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের ডোনার ছিলেন এবং স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত, এলাকায় নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। সবশেষ কোটা সংষ্কারের আন্দোলনে পুলিশ প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ছাত্রজনতাকে পেটানোর অভিযোগও জানা গিয়েছে গোয়েন্দা সূত্রে।
অপরদিকে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ভারত ও দুবাইতে টাকা পাচার, দিল্লীতে বিয়ে করে সংসারও রয়েছে এই ব্যবসায়ীর। বাংলাদেশে একাধিক বউ এবং ছেলে মেয়েও রয়েছে।আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের নারী উপহার দেওয়ার তথ্যও জানান তার ঘনিষ্ঠজনরা।
যদিও দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগ কখনো শেষ হয়ে যায় না। কমিশন চাইলে যেকোন সময় যেকারও বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান করতে পারে। আমরা বিষয়টি দেখবো। অভিযোগ যখন আসছে সুতরাং বিষয়টি নিয়ে কমিশনে আলোচনা হবে। কমিশনের কাছে মেরিট মনে হলে অবশ্যই নতুন করে অনুসন্ধান করা হবে। যারা তখন কাজ করেছে তাদের কাছেও বিষয়টি সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হতে পারে। আমরা বিষয়টি দেখবো।
অন্যদিকে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ও তার পরিবার বিগত কোনো সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গার বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনি কার্যক্রম দিলীপ কুমার আগরওয়ালার অফিসে পরিচালনা করা হয়েছিল। বিএনপি ২০০৮ সালে পরাজিত হওয়ার পর সে সুযোগসন্ধানী হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। ইতোপূর্বে জাতীয় পার্টির আমলে, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সামসুজ্জোহা ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আলমগীর হান্নানকেও জেলে পাঠায়।
বিতর্কিত মডেল পিয়াসা ও পাপিয়া গ্রেফতারের পর পুলিশের জেরার মুখে তারা দিলীপ আগরওয়ালার নাম বলেছিলেন। ডায়মন্ড চোরাকারবারে দিলীপের জড়িত থাকার বিষয়টি তারা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। তারা ছিলেন দিলীপের ডায়মন্ডের বাহক।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে বাংলাবার্তার পক্ষ থেকে দিলীপ কুমার আগারওয়ালের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি ফোনটি কেটে দেন। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। অপরদিকে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ব্যক্তিগত জীবনেও রয়েছে তার নানা কুখ্যাতি। আগের স্ত্রীকে দুবাই পাঠিয়ে নিজ কর্মস্থলে কর্মরত অন্যজনের বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করে বনানীর একটি ফ্লাটে থাকছেন। ইতোমধ্যে সেই নারীর স্বামী (নন্দ সাহা) তাকে ফেরত আনার চেষ্টা করায় তাকে প্রাণনাশের হুমকিসহ বিভিন্ন রকম হয়রানি করে আসছেন দিলীপ। এই জুয়েলারি চোরাকারবারির বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশন -বাজুসের সদস্যপদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং বর্তমানে বাজুসে তার কোনো প্রকার সদস্যপদও নেই।
এই বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি এই ধরণের অভিযোগ আসে তাহলে দুদকের উচিত এই বিষয়ে পুন:অনুসন্ধান করা।
বাংলাবার্তা/এআর