ছবি: বাংলাবার্তা
অবৈধ সম্পদ গোপন ও কর ফাঁকি দিতে পদে পদে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন আলোচিত ব্যবসায়ী নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। ভুয়া দলিল তৈরি করে মাছের খামার থেকে দুইশ ১৫ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান। অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগ মিলেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর কর্মকর্তাদের যোগশাসজে অনিয়ম করেন তিনি।
আরও পড়ুন>> বারবার দুদককে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন মতিউর রহমান
২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে নিজেকে মাছের খামারি দাবি করেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। কোম্পানির নাম মজুমদার ফিশারিজ। খুলনার দাকোপ ও সাতক্ষীরায় সাড়ে ১১শ হেক্টর জমিতে চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ ছাষ করার তথ্য দেন রিটার্নে। মাছ বিক্রি করে এক বছরেই আয় দেখান দুইশ দুই কোটি টাকা। যেখানে খরচ হয় ৯১ কোটি টাকা।
খামারের জন্য দাকোপের কালীনগরের শ্রীনগরের দুই ব্যক্তির কাছে পুকুর চুক্তি নেয়ার দলিল আয়কর রিটার্নে জমা দেন মজুমদার। দলিলের ঠিকানা ধরে হরি চরণ রায়ের পুত্র যোগেশ চন্দ্র রায়কে খুঁজে বের করে প্রতিবেদক। দলিলে মজুমদার দেখান, যোগেশের কাছে ৬শ ১৫ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। তবে যোগেশ জানান, এত জমি তার নেই। আর জমি কাউকে লিজও দেননি তিনি। চেনেন না নজরুল ইসলাম মজুমদারকেও। যোগেশ চন্দ্র রায় বলেন, আমার মোটে ১০-১২ বিঘা জমি আছে। আমি কাউকে জমি লিজ দেইনি।
আরও পড়ুন>> মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর নামে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার পাচার
এই এলাকার রইচ উদ্দিন গাজীর ছেলে আব্দুর রশিদ গাজীর কাছে তিন হাজার বিঘা জমি লিজ নেয়ার দলিল আয়কর রিটার্নে দেন মজুমদার। স্থানীয়রা জানান, শ্রীনগরে ঐ পরিচয়ের কোনো ব্যক্তি নেই। এত বেশি জমির মালিকও কেউ নেই। তাদের দাবি, আইলার আঘাতের পর এই এলাকায় আর বড় কোনো ঘের নেই।
২০২০-২১ অর্থবছরেও মৎস খামার থেকে ১৩ কোটি টাকা আয় দেখান মজুমদার। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, মৎস চাষের মাধ্যমে বিশাল অংকের অর্থ বৈধ করার বিষয়ে আপত্তি তোলেন অনেকেই। বিষয়টি গড়ায় আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাড় পান মজুমদার। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইসি। এরই মধ্যে মজুমদারের কর নথি সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। চলছে যাচাই-বাছাই। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কেউ ছাড় পাবেন না। ধীরে ধীরে গুরুত্বের সাথে কর ফাঁকি তদন্ত করা হবে।
আরও পড়ুন>> কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে টেকনাফে সাগর চুরি
এদিকে, সর্বশেষ আয়কর নথিতে ৫শ ৩২ কোটি টাকা অকৃষি সম্পদ, ব্যাংকে এফডিআর ৪শ ৪০ কোটি টাকা। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম ৯৮ কোটি, ব্যবসার মূলধন ২৬ কোটি, নগদ ৩০ কোটি টাকা দেখান নজরুল ইসলাম। বিপরীতে তার ব্যক্তিগত ঋণ তিনশ কোটি টাকা। হাজার কোটি টাকার এই মালিক গত অর্থবছরে কর পরিশোধ করেন মাত্র ১১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বাড়ি ভাড়া, ব্যবসার মুনাফা তার বৈধ আয়ের উৎস।
গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ পুরনো। তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। অভিযোগ আছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি, আমদানি রপ্তানিতে মূল্য কখনো কম- কখনো বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার করেছেন।
আরও পড়ুন>> মিথ্যা ঘোষণায় কুরিয়ার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে নভোএয়ারের ৩০ পণ্যের চালান
নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে গত বছর বেশকিছু প্রতিবেদন সামনে আসে। কিন্তু তার ক্ষমতার কাছে অসহায় ছিল সরকারি সংস্থাগুলো। তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
যুক্তরাজ্যের সরকারি ওয়েবসাইট ঘাটলেই নজরুল ইসলাম ও তার মেয়ের অর্থপাচারের তথ্য মেলে। লন্ডনে অন্তত চার কোম্পানিতে আনিকার মালিকানার প্রমাণ মেলে। এগুলো হল নাসা প্রপারটিস লিমিটেড, এএনডব্লিউ প্রপারটিস লন্ডন লিমিটেড, এএনডব্লিউ এসোসিয়েটিস লন্ডন লিমিটেড এবং এক্সিম এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড। সবগুলো কোম্পানি লন্ডনে নিবন্ধিত। এসব কোম্পানি আর্থিক ও আবাসন খাতের ব্যবসায় জড়িত। এএনডব্লিউ নামের কোম্পানিটিতে মেয়ের সঙ্গে পরিচালক ছিলেন নজরুল ইসলাম। সমালোচনার মুখে গত বছর তিনি পদত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন>>গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি
নজরুল ইসলাম মজুমদারের মেয়ে আনিকা ইসলামের বয়স ২৫ বছর। জাতীয়তা বৃটিশ। কোম্পানি নিবন্ধনে ব্যবহার করেছেন এসেক্সের ঠিকানা। তার নামে লন্ডনের বিলাসবহুল এলাকা কেনসিংটনে একাধিক বাড়ির খবর গণমাধ্যমে আসে গত বছর। যার মূল্য আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। সৌদি আরবেও নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ আছে।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, ঋণ অনিয়মসহ নানা অভিযোগ তদন্ত করছে আরেক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ। এরই মধ্যে নজরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
আরও পড়ুন>> সাদিক এগ্রোর প্রায় দেড় কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি
প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি’র সভাপতির দায়িত্বে নজরুল ইসলাম মজুমদার। অভিযোগ আছে, প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন তিনি। বিশেষ করে সিএসআরের অর্থে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দিতে বাধ্য করতেন। মুজিব শতবর্ষে খেলাধুলাসহ নানা আয়োজনে ব্যাংকগুলোকে চাঁদা দিতে বাধ্য করেন নজরুল ইসলাম। জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যে কোনো পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এর আগেও নানা বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনে আত্মগোপনে আছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
ফলে এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এআর