ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: বৈমানিক স্বল্পতার কারণে ২০১৯ সালে একাডেমিক পরীক্ষা ও যাচাই বাছাই করে ৩২ বৈমানিককে নিয়োগ দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বহুল দুর্নীতির কারণে বিমান থেকে উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকে তখন বহিষ্কার করা হয়। এমনকি তখন বিমান বিমানমন্ত্রণালয়ও এই দুর্নীতি খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি তখন ৩২ বৈমানিক নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতির কথা বলে। একই সাথে এই নিয়োগ বাতিলের সুপারিশও করা হয়। তবে বিমানে বৈমানিক হিসেবে আবেদন করার যোগ্যতা নেই এমন বৈমানিকরাও বিমানে নিয়োগ পেয়েছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সেই সব ভয়ঙ্কর তথ্য।
বাংলাবার্তার অনুসন্ধান বলছে, বিমান বাংলাদেশ তার প্রতিটি কর্মকান্ডে নিজস্ব নীতিমালা অনুসরণ করে (অপারেশনাল ম্যানুয়াল)। বিমানে এই বৈমানিকদের নিয়োগে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। এদিকে বৈমানিক নিয়োগে প্রার্থী নির্বাচনে বিমানের অপারেশনাল ম্যানুয়ালে প্রার্থীদের নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করা আছে। যেখানে বলা রয়েছে, বাংলা বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসিতে নূন্যতম গড় গ্রেড পয়েন্ট ৩ থাকা বাধ্যতামূলক। ইংরেজি মাধ্যম থেকে পাশ করা প্রার্থীদের ও লেভেলে (এসএসসি সমমান) সর্বশ্রেষ্ঠ ৫টি বিষয়ে গড় গ্রেট সি থাকতে হবে এবং এ লেভেলে (এইচএসসি সমমান) ২টা বিষয়ে গড় গ্রেড সি থাকা আবশ্যক। একই সাথে নীতিমালায় আরও বলা রয়েছে, জিইডি (GED) সনদ গ্রহনযোগ্য হবে না।
বাংলাবার্তার অনুসন্ধান বলছে, জিইডি যারা করে তাদের বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী পাইলট লাইসেন্স পাওয়ার কথা না। এটা আইনের ব্যত্যয়। বাংলাদেশ কার৮৪ এর রুল ২৪,রুল ২৬, রুল ৩২ অনুযায়ী পাইলট লাইসেন্স প্রার্থীকে অবশ্যই এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পদার্থ এবং গণিতসহ পাশ করতে হবে। প্রথমত জিইডিতে পদার্থ বিজ্ঞান নামক কোন বিষয় নেই। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ শিক্ষাবোর্ড জিইডিকে কখনোই এইচএসসির সমমান শিক্ষাগত যোগত্য হিসেবে গ্রহন করেনি। সুতরাং তাদেরকে সিভিল এভিয়েশন থেকে পাইলট লাইসেন্স প্রদান করা আইনের বিশাল ব্যত্যয় হয়েছে। উপরন্তু এইসব প্রার্থী শুধু লাইসন্স নিয়েই থেমে থাকেনি তারা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশ বিমানে নিয়োগ পেয়েছেন।
এমনকি কোন কারণে এই বৈমানিকদের দ্বারা বিমান যদি দুর্ঘটনায় পড়ে বা আইকাউ থেকে অনুসন্ধান হয় তাহলে বাংলাদেশ কালো তালিকা ভুক্ত হবে। যার ফলে বাংলাদেশের বিমান বিভিন্ন দেশে চলাচলার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা দেখে দেবে।
এদিকে বাংলাবার্তার অনুসন্ধান বলছে, বিমান বাংলাদেশ ৩২ বৈমানিক নিয়োগে প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী জিইডি (GED) সনদ গ্রহনযোগ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। তবে বাংলা বিভাগ থেকে আবেদন করা প্রার্থীদের গড় গ্রেড নীতিমালা অনুযায়ী ঠিক রাখা হলেও ইংরেজি মাধ্যমের গড় গ্রেড ‘বি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যা নীতিমালা থেকে বেশি রাখা হয়। কিন্তু বিমানের একটি কু চক্র মহল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বুঝতে পারে তাদের পছন্দের প্রার্থীরা নীতিমালা অনুযায়ী বিমানে নিয়োগে আবেদনই করতে পারবেন না। এমনকি তারা এটাও বুঝতে পারেন, তাদের পছন্দের প্রার্থীরা বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী আরও নিম্নমানের গড় গ্রেড ‘সি’, সেটাও তাদের প্রার্থীরা ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় অর্জন করতে পারেনি। একই সাথে বিমানের এমন কিছু প্রার্থী ছিলো যাদের শুধু জিইডি (GED) সনদ ছাড়া আর কিছুই নাই।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এরপর বিমানের কুচক্র মহলটি ৩২ বৈমানিক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিটি আবার সংশোধন করে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা মাধ্যমের গড় গ্রেড পয়েন্ট আগেরটা থাকলেও ইংরেজি মিডিয়ামের গড় গ্রেড এর জায়গায় গড় গ্রেড পয়েন্ট কমিয়ে ২.৪ উল্লেখ করা হয়, যা বিমানের নীতিমালার পরিপন্থী। একই সাথে জিইডি (GED) সনদ গ্রহনযোগ্য হবে না এই শর্তটি তুলে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ইংরেজি মিডিয়ামের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় সচরাচর শুধু গ্রেড প্রদান করা হয় গ্রেড পয়েন্ট নয়। নিম্নমানের এই গড় গ্রেড পয়েন্ট উল্লেখ এর দ্বারা বিমানের দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ৩২ বৈমানিক নেওয়ার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ১৪৯জন বৈমানিক আবেদন করেন। যার মধ্যে থেকে ১২০টি আবেদন বৈধ হিসেবে উল্লেখ করে বিমান। এরপর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মাধ্যমে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর এমসিকিউ এবং বর্ণনামূলক লিখিত পরীক্ষা নেয়। আর ৭৬জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ভাইবা (মৌখিক পরীক্ষা) ২০১৯ সালের ২০,২১ এবং ২২ জানুয়ারি নেওয়া হয়। এরপর সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ২৮জন বৈমানিক যোগদান করে। তবে যোগদান করা এই ২৮ বৈমানিকের মধ্যে ৯জন বৈমানিকের বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল এর গড় গ্রেড ‘সি’ এর নিচে। এই ৯জন বৈমানিক বিমানে যোগদানের আগে তাদের বায়োডাটা বিমানে সাবমিট করেন। ফলে বিমানে সাবমিট করা এবং বিমানেরই নিজস্ব সিভি ডাটাবেজ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ৯জন বৈমানিক বিমানে নিয়োগ পাওয়া তো দূরের কথা তারা আবেদন করার যোগ্যতাই রাখেন না। কিন্তু তারা বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এবং প্রায় ৬ বছর ধরে তারা বিমানে কর্মরত রয়েছেন।
বিমানে যোগদান করা ২৮ বৈমানিকের মধ্যে সেই ৯ বৈমানিক হলেন, বৈমানিক ইশমাম ইমতিয়াজ আহমেদ, তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ডি আর গণিতে সি পেয়েছেন। ইরফান হোসেন (ক্যাপ্টেন এন্তেখাব এর ছোট ভাই এবং ক্যাপ্টেন কামাল সাঈদের আত্মীয়), তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ই আর গণিতে বি পেয়েছেন। জোহরা মাহজাবিন মন্দিরা (সাবেক সংসদ সদস্যর শাহেদা তারেক দীপ্তির মেয়ে), তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে ই এবং গণিতে পেয়েছেন বি। আবু জাফর আহমেদ(ক্যাপ্টেন বেলালের ছেলে), তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ডি আর গণিতে পেয়েছেন সি। সাকিফ সাদমাম পাঠান, তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন সি আর গণিতে ই। জুনায়েদ রফিক (ক্যাপ্টেন রফিকের ছেলে) তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ই আর গণিতে বি পেয়েছেন। মাহমুদুল হাসান রাফিদ, তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ই আর গণিতে সি। নিয়াজ রহমান, তিনি এ লেভেল পরীক্ষায় ফিজিক্সে পেয়েছেন ডি আর গণিতেও ডি।
এখানে উল্লেখ্য আরও একটি বিষয়, বিমানের আরও একজন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থী মোক্তাদির আহমেদ। বিমান মন্ত্রণালয়ের কমিটির অনুসন্ধান অনুযায়ী মোক্তাদির আহমেদ তার ‘এ’ পরীক্ষার কোন গ্রেড জমা দেননি। কিন্ত অলৌকিক কারণে বিমানের ডাটাবেজে তার গ্রেড সি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই মোক্তাদির তখনকার বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম মোসাদ্দিক আহমেদের ভাতিজা।
ফলে নিয়োগ পাওয়া এই বৈমানিকরা বিমানের ম্যানুয়াল অনুযায়ী প্রথমত তারা আবেদন করার যোগ্যতাই রাখেন না। এরপর বিমানের প্রকাশিত দ্বিতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও তারা আবেদন করার যোগ্যতাই রাখেন না। তবুও অদৃশ্য কোন এক শক্তির কারণে তারা সবাই বিমানে নিয়োগ পেয়েছেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরেও তারা কিভাবে বিমানে নিয়োগ পেলেন জানতে একাধিক বৈমানিকের(৯জন বৈমানিক) সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি কয়েকজনকে মেসেজ পাঠানো হলেও তাদের কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
তবে এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলেন, প্রথমত একজন বৈমানিক নিয়োগে তার শিক্ষাগত যোগ্যতাকে প্রধান্য দেওয়া হয়। এরপর তার ট্রেনিং জীবন। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমেই যদি দুর্নীতি হয় তাহলে বৈমানিক জীবনে নানা প্রভাব ফেলবে। এতে করে একদিনে যেমন প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয় একই সাথে উড়োজাহাজ এবং যাত্রীদের জীবন শঙ্কা থাকতে পারে। কারণ তিনি তো মেধাবী নন। কাজেই যাদের আবেদনের যোগ্যতা নেই তবুও নিয়োগ হয়েছে এটা গ্রহনযোগ্য নয়। এমনকি এভিয়েমন সেক্টরে এটা কখনই গ্রহনযোগ্যতা পেতে পারে না।
তবে এ বিষয়ে জানতে বিমানের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো.মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বাংলাবার্তাকে বলেন, তখনকার নিয়োগটি নিয়ে যদি দুর্নীতি থাকে তাহলে বিমানকেই এখন সর্বপ্রথম সেটি অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে আমাদের যেসমস্ত বিষয়গুলো সেখানে রয়েছে সেগুলোও আমরা তদন্ত করবো। তখন কেন নিয়োগটি গ্রহন করা হয় এবং কারা এই নিয়োগে সম্পৃক্ত ছিলো সেটাও আমরা দেখতে পারি। সংষ্কার যেহেতু হচ্ছে দুর্নীতি রোধে আমরা অবশ্যই কাজ করবো।
বাংলাবার্তা/এআর