ছবি: বাংলাবার্তা
ঢাকা: ২০১৯ সালে বৈমানিক স্বল্পতার কারণে ৩২ বৈমানিক (ক্যাডেট পাইলট) নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিমান। তবে এর মধ্যে বিমানে তখন যোগদান করে ২৮ জন বৈমানিক তথা পাইলট। এই বৈমানিকদের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর বিমান বাহিনীর সদর দফতরে লিখিত পরীক্ষা (এমসিকিউ ও বর্ণনামূলক) অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় ১২০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১০৩ অংশগ্রহন করে।
বাংলাবার্তায় প্রকাশিত প্রথম পর্বের অনুসন্ধানে উঠে আসে এই ১২০ জনের মধ্যে অনেক প্রার্থী ছিলো যারা দুর্নীতি না করলে এই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহন করার যোগ্যতা রাখে না।
আরও পড়ুন>> আবেদন করার যোগ্যতা নেই তবুও তারা বৈমানিক
বাংলাবার্তায় এবারের দ্বিতীয় পর্বের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে,কিভাবে বিমানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় কিভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে উত্তীর্ণ করে বিমানে নিয়োগ দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমান মন্ত্রণালয় ও দুদকের অনুসন্ধানের কারণে ২০১৯ সালের ১৫ মে বিমান বাংলাদেশ-বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি চিঠি দেয়। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৩জুন বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার মো খালেদ হোসাইন স্বাক্ষরিত চিঠিতে উত্তর দেওয়া হয়। সেই উত্তর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘বিমান বাহিনী উত্তরপত্র সমূহ মূল্যায়ন শেষে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের মৌখিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সকল প্রার্থীকে এমিসিকিউ ও বর্ণনামূলক পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের সাথে যথাক্রমে ২০ ও ১০ নম্বর অতিরিক্ত হিসেবে যোগ করে ফলাফল প্রেরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমানকে’।
আরও পড়ুন>> নজরুল ইসলাম মজুমদারের সম্পদের পাহাড়!
ফলে এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, বিমানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা কিভাবে তাদের প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় অতিমাত্রায় খারাপ করার পরও বেশি নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে পরবর্তী ধাপে উন্নীত করেছেন।
তাদের মধ্যে থেকে নিয়োগ পাওয়া কিছু বৈমানিকের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হলো। যা দেখলে চোখ কপালে উঠবে যেকোন ব্যক্তির..
এখানে উল্লেখ্য,বাংলাদেশ বিমান বাহিনী লিখিত পরীক্ষায় পাশ মার্ক ৬০ এবং ৫০ বলে নির্ধারণ করেছিলো। কিন্তু ফলাফল অনুযায়ী দেখা যায়, বিমানে নিয়োগ পাওয়া বৈমানিকদের যদি লিখিত পরীক্ষার এমসিকিউতে ২০ এবং বর্ণনামূলকে ১০ নম্বর যদি না দেওয়া হতো তাহলে উল্লেখিত কোন প্রার্থীই আলাদাভাবে তো দূরের কথা এমসিকিউ এবং বর্ণনামূলকের গড় ৫৫ নম্বরও তারা পাননি। ফলে এই প্রার্থীরা কোনভাবেই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে পারতেন না এবং তারা মৌখিক পরীক্ষা(ভাইবা) দেওয়ার সুযোগ পেতেন না। বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী যেখানে তারা লিখিত পরীক্ষাতেই বাদ পড়ে যান। কিন্তু এখানেও দুর্নীতি করেছে বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন>> বিএডিসি ‘ভক্ষকের ভূমিকায়’ গায়েবের পথে হাজার কোটি টাকার সার!
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, বিমানের কর্মকর্তারা নীতিমালা ভঙ্গ করে লিখিত ও মৌখিক দুটোতেই সমপরিমাণ ১০০ ও ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়। কিন্তু বিমানের নীতিমালায় বলা রয়েছে, লিখিত পরীক্ষায় ৭৫ শতাংশ এবং মৌখিক পরীক্ষায় ২৫ শতাংশ নম্বর দিয়ে সর্বমোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষা নিয়ে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু এখানেও বিমানের কর্মকর্তারা তাদের প্রার্থীদের পাশ করিয়ে দুর্নীতি করেছেন। ফলে বিমানে নিয়োগ পাওয়া এই বৈমানিকরা সর্বপরী কম নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও কোন এক অজানা ক্ষমতাবলে তাদেরকে মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নাম্বার দিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বিমানের নিয়োগ যোগ্য হয়েছেন। এমনকি বিমানের লিখিত পরীক্ষায় এমন অনেক প্রার্থী ছিলো যারা লিখিত পরীক্ষায় এসব প্রার্থীদের চেয়ে বেশি নাম্বার পাওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়েছে। অপরদিকে বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী, লিখিত পরীক্ষার গড় মৌখিক পরীক্ষার চেয়ে ৩গুণ বেশি। ফলে একজন প্রার্থীকে শুধু মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু এখানেও বিমানের নিয়ম ভঙ্গ করে লিখিত পরীক্ষায় বেশি পাওয়ার মৌখিক পরীক্ষায় কম নাম্বার দিয়ে ফেল করানো হয়েছে। আবার লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া বিমানের পছন্দের প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নাম্বার দিয়ে পাশ করানো হয়েছে।
আরও পড়ুন>> পুন:অনুসন্ধান হতে যাচ্ছে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার দুর্নীতি
এমনকি বিমান মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে উঠে আসে, মৌখিক পরীক্ষায় বিমানের যেসব পর্ষদের কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা ছিলো তারা সবাই উপস্থিত ছিলেন না। বিমানের চীফ অব ট্রেনিং যার মৌখিক পরীক্ষায় থাকার কথা আবশ্যক তিনিও এই পরীক্ষার বিষয়ে তখন কিছুই অবগত ছিলেন না। অপরদিকে বিমান মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানের সময় বিমানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অনুসন্ধান কর্মকান্ডে কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলেন, যারা যোগ্য নন তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া মানে প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হওয়া। এটা যদি হয়ে থাকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে তাহলে এই নিয়োগ বাতিলযোগ্য। যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্য নিয়োগ দেওয়া কখনো কাম্য নয়। যতদূর জানি বিমানের তদন্তে তখন দুর্নীতি উঠে আসে। নিয়োগও বাতিল করতে বলা হয়। কিন্তু অজানা কোন কারণে এই নিয়োগ বাতিল হয়নি সেটা আমার বোধগম্য নয়। সর্বপরী এটি হলে এভিয়েশনখাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। দেশের সুনাম নষ্ট হবে। বিমানকে আরও স্বচ্ছ হতে হবে। দুর্নীতি বন্ধে কঠোর হতে হবে।
আরও পড়ুন>> শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে এনবিআর
এদিকে এ বিষয়ে বিমানের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই দুর্নীতির বিষয়ে বিমান আদতে এখন কি ব্যবস্থা নেবে সেটাও জানা সম্ভব হয়নি।
তবে বিমানে বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ৩২ বৈমানিকের বিষয়ে এই প্রতিবেদক তখনকার বিমান প্রতিমন্ত্রি মাহবুব আলীর সঙ্গে কথা বলেন,তখন তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, আমরা কোন দুর্নীতি গ্রহন করবো না। বিষয়টি নিয়ে উচ্চমহল পর্যন্ত আলোচনা চলছে। যদি কেউ দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকে তাহলে কি ব্যবস্থা নেবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিমানের নিজস্ব আইন রয়েছে। সেই আইনে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদকও চার্জশিট দিয়েছে। আমরা কিন্তু বসে নেই। আমরাও আমাদের কাজ করছি। সময় হলে সব জানতে পারবেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্খা নেওয়া হলো। তবে এই প্রতিমন্ত্রী এই অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি।
আরও পড়ুন>> বসুন্ধরা-বেক্সিমকোসহ ৫ প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির অনুসন্ধানে এনবিআর
এমনকি এই প্রতিবেদক এই দুর্নীতির সংবাদ অনুসন্ধানের সময় এর আগের সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে। তখন তার কাছে প্রশ্ন ছিলো, যেখানে বিমান মন্ত্রণালয় এবং দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে সেখানে সিভিল এভিয়েশন এই নিয়োগ কিভাবে গ্রহন করলো? জবাবে মফিদুর রহমান বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। কিন্তু এই চেয়ারম্যানও কোন ব্যবস্থা নেননি।
আরও পড়ুন>> রেজাউল হকের দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারিতে ডুবেছে এসআইবিএল ব্যাংক
তবে সিভিল এভিয়েশনের বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো.মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বাংলাবার্তাকে বলেন, তখনকার নিয়োগটি নিয়ে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে আমরা বিশ্লেষণ করে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো। তখন কেন নিয়োগটি গ্রহন করা হয় এবং কারা এই নিয়োগে সম্পৃক্ত ছিলো সেটাও আমরা দেখতে পারি।
বাংলাবার্তা/এআর