ছবি: বাংলাবার্তা
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে আমদানি করা একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি জালিয়াতির মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে খালাস করেছে একটি চক্র। চক্রটির কারণে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এমনকি গাড়িগুলো আমদানি করার পর কাস্টম কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই খালাস করেছেন। অপরদিকে, এসব গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে মূল্য ঘোষণায়ও বড় জালিয়াতি করেছে চক্রটি। সাধারণত গাড়ি খালাসের কাজ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দুটি শাখা। একটি পরীক্ষণ; অন্যটি শুল্কায়ন গ্রুপ।
সম্প্রতি আটক হওয়া বিএমডব্লিউ গাড়িটির তথ্য অনুসন্ধানের পর শুল্ক গোয়েন্দা জানতে পারেন, ‘গাড়িটির পুরো প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করা হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই গাড়িটি খালাস করা হয়েছে। যেখানে কাস্টম কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘সম্প্রতি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের ‘চট্টমেট্রো-গ-১৪-১৭৪৫’ নম্বরের গাড়িটি আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দা। গাড়িটি আমদানি করে চট্টগ্রামের নাগোয়া করপোরেশন। ২০২০ সালের ৩ মে ব্র্যান্ড নিউ বিএমডব্লিউ প্রাইভেটকারটি খালাস নেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। খালাসের সময় গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৫ সিরিজের ‘৫৩০-ই’ মডেলের ঘোষণা দেওয়া হয়। মূলত গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৭ সিরিজের ‘৭৪০-ই’ মডেলের। উৎপাদন হয় ২০১৭ সালে। তবে আমদানির সময় উৎপাদন সাল দেখানো হয়েছে ২০১৯ সাল। তবে গাড়িটি রিকন্ডিশন। আনা হয়েছে জার্মানী থেকে কিন্তু জার্মানী থেকে আসলে নতুন গাড়ি আসবে। তখন প্রায় ২ কোটি ট্যাক্স আসে গাড়িটিতে। তবে মাত্র ৫৩ লাখ টাকা ট্যাক্স দিয়ে কাস্টম কর্মকর্তাদের যোগসাজসে খালাস করা হয়েছে গাড়িটি।’
এই গাড়িটি তখন শুল্কায়নে ছিলেন— চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা কুশল চন্দ্র মজুমদার, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ফজলুর রহমান ও ডেপুটি কমিশনার মো. ফয়সাল বিন রহমান। আর পরীক্ষণে ছিলেন— রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান ও সহকারি কমিশনার ( বর্তমানে উপ-কমিশনার) মো. আমিনুল ইসলাম।
আরও জানা যায়, ‘শুল্কায়ন কর্মকর্তা গাড়ির সমসাময়িক মূল্য দেখবে। গাড়িটি বাংলাদেশে আমদানির যোগ্য কিনা সেটা শুল্কায়ন কর্মকর্তা নির্ধারণ করবেন। ফলে শুল্ক ফাঁকির পেছনে বড় যোগসাজস হয়েছে এখানে। এমনকি পাশ্ববর্তী দেশের মূল্যও তিনি দেখবেন। এমনকি শুল্কায়ন নোটেও তিনি কিছু লেখেননি। এছাড়া গাড়িটি সঠিক রয়েছে কিনা সেটাও দেখার দায়িত্ব ছিল শুল্কায়ন কর্মকর্তাদের।’
অপরদিকে, ‘পরীক্ষণ কর্মকর্তারা গাড়ি দেখবে। পরীক্ষণ যিনি করেছেন, তার গাফিলতি ছিল। চেচিস নাম্বার দিয়ে সার্চ দিলে গাড়ির সকল তথ্য চলে আসার কথা। গাড়িটি ব্র্যান্ড নিউ নাকি পুরাতন, সবকিছু যাচাই-বাছাই করার কথা। সকল তথ্য যাচাই-বাছাই করেননি পরীক্ষণ কর্মকর্তা। পুরনো গাড়ি আসলেও সেটা দেখেননি পরীক্ষণ কর্মকর্তা। ফলে এটাও এক প্রকার নিষিদ্ধ পণ্য। এখানে শুল্ক হবে ডাবল। দ্বিগুণ জরিমানাও হতো; যদি পরীক্ষণ কর্মকর্তা বের করতেন। গাড়িটি ঘোষণায় মিথ্যা রয়েছে। এখানে অসদুপায় অবলম্বন করেছেন পরীক্ষণ কর্মকর্তারা। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গাড়ির সঠিক মূল্য নির্ধারণের জন্য কাস্টম হাউসগুলোতে নানা ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হয়। সেখানে একটি গাড়ির সঠিক তথ্য এবং মূল্য জানতে মাত্র ১-২ ডলার মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ফলে পরীক্ষণ কর্মকর্তারা সেটাও করেননি।’
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মিনজাহ উদ্দিন বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘গাড়িটি ৪ বছর আগে খালাস নেওয়া। কম ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি বাদেও বেশ কয়েক ধরনের জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আমদানি নথিতে গাড়িটির দাম ২০ হাজার মার্কিন ডলার ঘোষণা দেওয়া হয়। শুল্কায়ন করা হয় ৪০ হাজার মার্কিন ডলার দেখিয়ে। অথচ গাড়িটির মূল্য এক লাখ ডলারের মতো। এতে গাড়িটির মূল্য অন্তত ৬০ হাজার ডলার কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। গাড়িটি ৫৩ লাখ টাকা শুল্ক দিয়ে খালাস নেওয়া হয়। এটি যেহেতু ২০১৭ সালের তৈরি, কিন্তু খালাসের সময় ২০১৯ সালের তৈরি উল্লেখ করে শুল্কায়ন হয়েছে। গাড়িটির বর্তমান বাজারমূল্য দুই কোটি টাকার বেশি।’
অপরদিকে গাড়িটি নাগোয়া করপোরেশনের মালিক সাকিব চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
এ বিষয়ে এলএনবি অটোমোবাইলসের স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান মাহমুদ বলেন, ‘বিএমডব্লিউ গাড়িটি বিক্রি হয়েছিল চট্টগ্রাম শো-রুম থেকে। গাড়িটির বিষয়ে বিস্তারিত জেনে বলতে হবে।’
এদিকে রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডা বলছে, ‘ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি আমদানি করেন হাতেগোনা দু-একজন। আগের উৎপাদন হলেও আমদানির সাল বাড়িয়ে দেখালে বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়। কারণ এতে ক্রেতারা মনে করেন গাড়িটি লেটেস্ট। এতে বিক্রেতা বেশি লাভবান হন। তবে এখানে যা হয়েছে সেটাকে তারা দুর্নীতি মনে করছেন।’
এ বিষয়ে জানতে কাস্টমসের তখনকার শুল্কায়ন এবং পরীক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘যাদের দায়িত্ব ছিল সঠিকভাবে সবকিছু দেখা তারা যদি সেটা পালন না করেন তাহলে এটা দুর্নীতি। কিভাবে এই গাড়িগুলো বের হয়েছে কিংবা সঠিকভাবে কেন শুল্ক আদায় হলো না সেটা কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখা তলব করা উচিত। প্রয়োজনে কাস্টমসের যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। বিচারহীনতা কিংবা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি থাকলে এনবিআরের উচিত এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা কাস্টম কর্মকর্তাদের বিষয়ে জানি। আশা করি, এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যবস্থা নেবেন এবং সঠিক তথ্য গণমাধ্যমকে জানাবেন।’
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বাংলাবার্তাকে বলেছেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা দেখছি। এখানে যদি কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যায় কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে কোনো ধরনের আপোস নয়। আমার কঠোর বার্তা হলো, দুর্নীতিকে না বলুন এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সবাই এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টমসের সাবেক দুইজন কমিশনার বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘কাস্টম হাউসগুলোতে যারা গাড়ির গ্রুপগুলোতে কাজ করে এখানে দুর্নীতির শেষ নেই। তবে দেখে শুনে এবং সততার সাথে কাজ করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। পরীক্ষণ এবং শুল্কায়ন কর্মকর্তা যারা তাদের অবশ্যই উচিত আমদানিকারক বা সিএন্ডএফ যে তথ্যগুলো দিয়েছে সেগুলো সঠিক কিনা সেটা যাচাই বাছাই করা। এখন ডিজিটাল যুগে সেটা যাচাই বাছাই করা খুব সহজ। যদি তারা যাচাই বাছাই করতেন বা উর্দ্ধতন যারা তখন ছিলো তাদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতেন তাহলে এভাবে আকাশ পাতাল হওয়া সম্ভব না। এখানে ঘোষণায় মিথ্যা তথ্যসহ নানা জটিলতা ছিলো। তাহলে অবশ্যই অনুমেয় এখানে কোন যোগসূত্র ছিলো নয়তো এমনটা হওয়া আদতে সম্ভব নয়।’
বাংলাবার্তা/এসজে/এমআর