
সংগৃহীত
ঢাকা: নানা অনিয়ম,অন্যায়,ঘুষ,দুর্নীতি আর তদবীরবাজ হিসেবে পরিচিত তিনি হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কাস্টম কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান।এনবিআরে কর্মরত থাকাকালীন এমন কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি নেই যা তিনি করেননি। টাকা দিয়ে সকল অপকর্ম ধামাচাপা দিয়ে করেছেন আয়েশি জীবন যাপন। এমনকি ৫ বছর ধরে চলা দুর্নীতির ফাইল পর্যন্ত দুদকে থমকে গিয়েছে তার ইশারায়। এমনকি অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে চাকরি জীবনে কখনো খারাপ পোস্টিং নেননি এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক এই কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানাধীন শৈলঢুবি গ্রামে হলেও তিনি পরিচয় ব্যবহার করতেন গোপালগঞ্জের। এমনকি সরাসরি সখ্যতা ছিলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ,সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী প্রয়াত সাজেদা চৌধুরীসহ অসংখ্য প্রভাবশীলীদের সাথেও তার সখ্যতা ছিলো।
জানা যায়, এই সাবেক কর্মকর্তা নুরুজ্জামান ২০০৯ সালে ঢাকা দক্ষিণে পদায়ণ থাকাকালীন সময়ে চাকরি দিয়েছেন এলাকাবাসী এবং আত্নীয় স্বজনদের। ওই নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় পড়েন নুরুজ্জামান।কিন্তু আওয়ামী সরকারের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় চাকরি থেকে রক্ষা পান। ২০১৩ সালে কমলাপুর আইসিডিতে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ব্যাপক গুড়া দুধ কেলেংকারীতে পড়েন এই কর্মকর্তা। তখন সরকারের উপরিমহলে গোপালগঞ্জের দোহাই দিয়ে কোনমতে ওই যাত্রায় বিপদ সামলান।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কয়েকটি স্থলবন্দর থেকে রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজার পর্যন্ত গড়ে ওঠা চোরাই পণ্যের কারবারি সিন্ডিকেটকে সহায়তা দিতেন সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান। রাজস্ব বিভাগের বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক গোয়েন্দা এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই তথ্য। কিন্তু ওই সময়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট পুরান ঢাকার গুলশান আরা সিটি মার্কেটের সামনে কাভার্ড ভ্যান থেকে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সৈয়দ আবিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ও খন্দকার সুরাত আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। মামলার তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শতকোটি টাকারও বেশি শুল্ক ফাঁকির তথ্য মেলে। এখানেও এই কর্মকর্তার সখ্যতা ছিলো।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের মাসুদ প্যাকেজিং, মেসার্স ইসলাম অ্যাসোসিয়েটসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া নথি তৈরি করে ডুপ্লেক্স বোর্ড কাগজ আমদানি করে চোরাকারবারির অভিযোগে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আদমজী ইপিজেড কেন্দ্রিক মেসার্স আঙ্কেল প্যাকেজিং লিমিটেড এর নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলা সিআইডি তদন্ত করে। যেখানে এই এনবিআর কর্মকর্তার সখ্যতা মেলে।
অপরদিকে চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার নামের দুই সহোদরের শুল্ক ফাঁকি ও চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরপর দীপুকে গ্রেফতার করেন শুল্ক গোয়েন্দা। ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। অপুর মালিকানাধীন মেসার্স চাকলাদার সার্ভিস এবং দীপুর মালিকানাধীন এমআর ট্রেডিংয়ের সঙ্গে কাস্টমস কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান এর সখ্যতা থাকায় সার্বিক সহযোগিতা করেন তিনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সাবেক এই কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান ২০১১ সালে ঢাকা পূর্বে বন্ড কমিশনারেটে থাকা অবস্থায় দেদারসে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমস এ কর্মরত অবস্থায় অবৈধ টাকা কামিয়েছেন। চট্রগ্রাম থাকাকালীন সময়ে কয়েকশ' কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ২০২২ সালে ঢাকা পানগাওতে সিগারেট ও মদ কন্টিনার গায়েবের মামলায় আসামি হন কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান। মামলাটি হাইকোর্টে চলমান রয়েছে।
এমনকি নুরুজ্জামান চট্টগ্রামে পোস্টিং থাকা অবস্থায় পোর্ট থেকে কন্টেইনার চুরির সাথে জড়িত ছিলেন। ওসব কন্টিনারে ছিলো ফেব্রিকস (কাপড়) । ওই মামলাটি ধামাচাপা দিতে সাবেক আইনমন্ত্রীকে মোটা অংকের টাকা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন নুরুজ্জামান। মামলাটি চলমান রয়েছে।
নুরুজ্জামান-পাপিয়া দম্পতির এক ছেলে দাইয়ান ও এক মেয়ে নিশাত। বর্তমানে মেয়ে লন্ডনে বসবাস করেন। নুরুজ্জামানের অস্ট্রেলিয়াতে আলিশান বাড়ি, গাড়ি ও সম্পতি রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। রাজধানীর অদুরে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় স্ত্রী পাপিয়ার নামে রয়েছে একটি গার্মেন্টস। গার্মেন্টসটি পরিচালনা করেন তার চাচাত ভাই মহিউদ্দিন। এই সাবেক কমিশনার থাকেন ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে। ওই বাড়ির সামনের বাড়িতে একটা ফ্ল্যাট রয়েছে।সেখানে থাকেন শ্যালক হাবিবুর রহমান হেন্ডি।
এ বিষয়ে জানতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কমিশনার একেএম নুরুজ্জামানের ব্যক্তিগত ফোনে ফোন দিলে তিনি কলটি রিসিভ করে পরিচয় দেওয়ার পর লাইনটি কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন এবং বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনা সাড়া দেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
যদিও এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো আখতারুল ইসলাম বাংলাবার্তাকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে বিশদ জানা যেতে পারে।
অপরদিকে নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক দুদকের একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বাংলাবার্তাকে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এই মামলায় ক্ষমতা প্রভাব বিস্তার করা থেকে সবকিছুই করেছেন এনবিআরের সাবেক একজন কমিশনার। এমনকি উপরিমহল থেকেও চাপ ছিলো। যার কারণে তদন্তটি দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পড়ে আছে।
এসব বিষয়ে যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর)মো আবদুর রহমান খান বাংলাবার্তাকে বলেন, রাজস্ব সংশ্লিষ্ঠ কোন অন্যায় আমরা মেনে নিবো না। অতীতের যেকোন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো আমরা খোঁজ নিচ্ছি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা নানা বিষয়গুলো জানতে পারি। এগুলো আরও বেশি বেশি উঠে আসা উচিত। আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিবো এবং কি অবস্থায় রয়েছে সেটি জেনে গণমাধ্যমকে অবহিত করবো। কোন দুর্নীতি কিংবা অন্যায় আমরা মেনে নিবো না।
বাংলাবার্তা/এসজে