
ফাইল ছবি
ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্ব ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেট (বর্তমানে যা ভেঙ্গে উত্তর এবং দক্ষিণ করা হয়েছে)। এই বন্ড কমিশনারেটের দুর্নীতি নিয়ে ২০২২ সালে একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে। দুদকের যাচাই বাছাই কমিটি বিষয়টি তখন আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ৩টি বছর অতিবাহিত হলেও এখনো অনুসন্ধান কর্মকর্তারা কমিশনে দাখিল করেননি অনুসন্ধানি প্রতিবেদন। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে আরও যেমন বেপরোয়া হয়েছে দুর্নীতিবাজ কাস্টম কর্মকর্তারা। ঠিক তেমনিভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভাবমূর্তি নিয়েও দেখা দিয়েছে বিশদ প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের(দুদক) সাবেক মহাপরিচালক লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন মো.মঈনুল ইসলাম বাংলাবার্তাকে বলেন, দুদক বিধি ৭-এ বলা রয়েছে,প্রথমে অনধিক ৪৫ কার্যদিবস পাবে অনুসন্ধান কর্মকর্তা। সেই সময়ে না হলে অনধিক ৩০ কার্যদিবস। এরমধ্যে কমিশনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিল না হলে কমিশন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবে বা দ্বিতীয় অনসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারবে। তবে প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা ৭৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন না দিলে তার গাফিলতি থাকলে কমিশন সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তবে দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে কমিশন সময় বেঁধে দেবে তার কতোদিন সময় লাগবে। এখানে ২-৩ বছর চলার দায় সম্পর্ণ কমিশনের। কমিশন এগুলো এলাও করে বলে এতোসময় লাগে। এখানে কমিশনের পুরো দায় রয়েছে।
দুদকে দায়ের হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, তখনকার ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেট নিয়ে বলা হয় সিপাহী থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত ঘুষের হাট বসিয়েছেন। এখানে প্রতিদিন ঘুষের হাটে চলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন। টাকা না দিলে চলে হয়রানি। নতুন লাইসেন্স ইস্যু,বার্ষিক নিরীক্ষা,প্রাপ্যতা, এইচএসকোড ইস্যু,ইউপি ইস্যু,কাটিং তদারকি থেকে শুরু করে সব কাজে দিতে হয় ঘুষ। আর ঘুষের হাটের দোকনদারি বসায় সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তারা। প্রতিদিন অভিনব সব কৌশল তৈরি করে নেওয়া হয় ঘুষ। ঢাকা কাস্টম বন্ড কমশিনারেট ভেঙে উত্তর এবং দক্ষিণ হয়েছে। তবে অনুসন্ধান বলছে, বর্তমানেও আগের মতো চলমান রয়েছে ঘুষের হাটবাজার।
লাইসেন্স ইস্যুতে নেওয়া হয় প্যাকেজ ঘুষ
নতুন লাইসেন্স ইস্যুতে ব্যবসায়ীরা সব কাগজপত্র জমা দেয়। এরপর লাইসেন্স শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) স্নিগ্ধা বিশ্বাসের নেতৃত্ব ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করা হয়। তখন সদস্য কাস্টম নীতি মাসুদ সাদিকের প্রশ্রয়ে ডিসি স্নিগ্ধা যোগদানের পর থেকেই ঘুষ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। প্যাকেজ ঘুষে রাজি না হলে নানা কারণ দেখিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হয় না। লাইসেন্স দিতে ঘুষের প্যাকেজ ঠিক করে লাইসেন্স শাখার সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা মহসিন হোসেন,গোলাম সারোয়ার এবং রাজস্ব কর্মকর্তা মো আব্দুল হালিম। এরা সবাইকে জিম্মি করেই টাকা নেয়। লাইসেন্স নবায়নে ঘুষের শুরু করে ৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা। যেখানে কমিশনার পান ৫ লাখ, ডিসি পান ৬-৭ লাখ,আরও ২-৪ লাখ, এআরও ১০-১৫ লাখ,সিপাহী ও শাখা সহকারি ২০-৫০ হাজার।
বার্ষিক নিরীক্ষার নামে চলে প্যাকেজ ঘুষ
বন্ডের হয়রানি আর ঘুষের আরেক স্বর্গরাজ্য হলো বার্ষিক নিরীক্ষা শাখা। বন্ড প্রতিষ্ঠানের আমদানি রফতানি নিয়ে প্রতি বছর বার্ষিক নিরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে সমস্যা না থাকলেও দিতে হয় ঘুষ। যেসকল প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করেনি তাদেরও বার্ষিক নিরীক্ষা করতে দিতে হয় ৫-৭ লাখ টাকা ঘুষ। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম থাকে তাদের দিতে হয় ৫০ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। সমস্যার ধরণ অনুযায়ী নিরীক্ষা শাখার এআরও ঘুষের দরদাম ঠিক করে দেন। ঘুষের টাকায় জেসি দেন লাইসেন্স প্রতি ৪-৫ লাখ, রাজস্ব কর্মকর্তা সুভাস চন্দ্র বোস ২ লাখ, সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা শামসুননাহার ৫ লাখ, শাখা ৫০ হাজার, সিপাহী ও ফালতু নেন ১০ হাজার।
ইউপিতে ঘুষ নেওয়া হয় ডিপিএস পদ্ধতিতে
ডিপিএস পদ্ধিতে ঘুষ ভাবতে পারেন। কিন্তু ভাবনার জায়গা থেকে বেরিয়ে এবার একটু জেনে আসুন ঢাকা কাস্টম বন্ড কমশিনারেটে কিভাবে ডিপিএস পদ্ধিতিতে কে কে ঘুষ নিয়ে থাকেন। এখানে ঘুষ নিয়ে থাকেন জেসি আকতার হোসেন, ডিসি সাদিয়া আফরোজ, কালিদ হোসেন খন্দকার,আরও সুভাস চন্দ্র বোস, শিবানী রায়,মো শফিকুল ইসলাম। প্রতিটি ফাইল স্বাক্ষর করার পর অটো টাকা চলে যায় একাউন্ড নাম্বারে। সমস্যা না থাকলে ১০ হাজার আর সমস্যা থাকলে ১০৫ লাখ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।
এইচএসকোড অনুমোদনে দোকান বসিয়ে ঘুষ
একটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান। এইচএসকোড অনুমোদনে শাখায় ঘুষ দিতে হলো ১০ হাজার টাকা। ডিসি থেকে কমিশনার পর্যন্ত ফাইল অনুমোদনে ঘুষ গেল ২ লাখ টাকা। আরও ফাইলে নোট দিতে নেন ২-১০ লাখ টাকা। আর প্যাকেজের ঘুষ পান আরও,ডিসি ও জেসি। অনেক সময় এডিসি ও কমিশনারও পান।
প্রিভেনটিভের নামে চলে ঘুষ বাণিজ্য
বন্ড সুবিধার কাঁচামাল যেন খোলা বাজারে বিক্রি না হয় সেজন্য প্রিভেনটিভ টিম কাজ করেন। রাতে বিভিন্ন সড়কে,মহাসড়কে,বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালানোর কথা এই টিমের। পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে রয়েছে বিশাল একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে প্রিভেনটিভের বিশাল এক যোগসূত্র। এমন কি এই পণ্য কোথায় যাবে সেখানে পাহারা পর্যন্ত দিয়ে থাকে প্রিভেনটিভ টিম। যার বিনিময়ে নেন লাখ লাখ টাকা ঘুষ। অপরদিকে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বেশিরভাগ মদ চলে যায় খোলাবাজারে। যেখানে সরাসরি জড়িত কমিশনার পর্যন্ত।
বন্ড খেকো জেসি আখতার ও আরও সুভাস
বন্ডে আতঙ্কের নাম জেসি আখতার হোসেন। বন্ডে ডিসি থেকে পদোন্নতি পেয়ে জেসি হয়েছেন। বন্ডদের কাছে তিনি আযান দিয়ে ঘুষ নেন। জেসি আখতারের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও এনবিআরে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নিকর্তৃপক্ষ। আখতারের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বন্ডে পদায়নের অভিযোগ রয়েছে। যে কমিশনার আসুক আখতার তার ইচ্ছামত পদায়ন নেন। ঘুষ না দিলে চরম হয়রানি করে আখতার। জেসি হিসেবে পদোন্নতিতে কোটি টাকা খরচ করেছেন। এনবিআরের একজন সদস্য ও প্রথম সচিবকে কোটি টাকার দিয়ে পদোন্নতি নিয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়ার পর জেসি হিসেবে বন্ডে থাকার জন্য প্রথম সচিবকে ১ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন।
এছাড়া আরও সুভাস বন্ডে ইউডি ছিলেন। পরে সহকারি কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পেলে তখনকার কমিশনার তাকে বন্ডে রেখে দেন। এরপর থেকে সুভাস বন্ডে অঘোষিত দাদা হিসেবে পরিচিত। তিনি ৩বার এআরও হিসেবে বন্ডে পোস্টিং নিয়েছেন। এই পোস্টিং এর জন্য সুভাস কোটি টাকা খরচ করেছেন। এমনিক এনবিআর চাইলেও সুভাসকে বদলি করতে পারে না।
বন্ড কমিশনার ও অতিরিক্ত কমিশনার শামীমার ঘুষের ফিরিস্তি
৩জন সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তার মাধ্যমে ঘুষ নিতেন কমিশনার। আর এই কর্মকর্তারা বাসায় গিয়ে কমিশনারের টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন। এছাড়া অতিরিক্ত কমিশনার শামীমা আক্তারের ঘুষ নেওয়ার পদ্ধতি আরও অভিনব। তিনি জিম্মি করে ঘুষ নেন না। রাজস্ব কর্মকর্তা,সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা ও সিপাহীদের মাধ্যমে ঘুষ নেন শামীমা। এরাই শামীমার টাকা বাসায় ও নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়।
অপরদিকে ডিসি সাদিয়া আফরোজ ও প্রিয়াংকা দাস শিপুও একইভাবে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ঘুষ নিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে জানতে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বাংলাবার্তাকে বলেন, আগের সরকারের সময়ে এগুলো নিয়ে কাজ করতে নানা সমস্যায় তাদের পড়তে হয়েছে। বর্তমান কমিশন অবশ্যই অনুসন্ধানে গতি আনতে নির্দেশনা দিয়েছে। যেসব অনুসন্ধান দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে সেগুলো দ্রুতই শেষ হবে।
যদিও এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতারুল ইসলাম বাংলাবার্তাকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার একটি নির্দিষ্ঠ সময় রয়েছে। আশা করি অনুসন্ধান কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি জানাতে পারবেন।
তবে এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি)নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংষ্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বাংলাবার্তাকে বলেন, আগে প্রায়ই শোনাযেত অনুসন্ধানে বছরের পর বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এটা কখনো শোভনীয় নয়। বর্তমান কমিশনের উচতি যেগুলো দুর্নীতির বিশদ বিবরণ রয়েছে সেগুলো অনুসন্ধান দ্রুতই শেষ করা। জনগণের কাছে দুদককে আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা। দুদক যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তভাবে এগিয়ে যাবে তখন দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে