
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা: ঘুষ, দুর্নীতির এক মহোৎসব চলছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন বেনাপোল কাস্টম হাউসে। আর সবকিছুই চলছে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে। এছাড়া বর্তমান কমিশনার মো কামরুজ্জামান জয়েন করার পর থেকেই দুর্নীতির মাত্রা ক্রমশ বেড়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে এমনই একটি অভিযোগ এসেছে। এছাড়া বেনাপোল কাস্টম হাউসের সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে প্রথম পর্ব ছাড়াও থাকবে আরও দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব।
সেই অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বেনাপোল কাস্টম হাউসের শুল্ক কর্মকর্তাদের শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পরও ঘোষণার বাইরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কেজি পণ্য পাওয়া গিয়েছে। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কর্তৃক আটক করা ট্রাকের পণ্য চালান ইনভেন্টরি করে এ প্রমাণ মিলেছে। বিষয়টি স্পষ্ট করেছে, বিজিবি আটক না করলে এ বিশাল শুল্ক ফাঁকির ঘটনা আড়ালেই থেকে যেত। সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি, কী ধরনের পণ্য দেশে প্রবেশ করছে, সেটিও অজানা থাকত। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের একজন ব্যবসায়ী লিয়াকত আলীর দাখিল করা এক অভিযোগে এমনটাই জানা গিয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। রাজস্ব ঘাটতি এরই মধ্যে ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের দায়িত্বে থাকা শুল্ক কর্মকর্তাদের সামনেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য চালান খালাস হচ্ছে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য চালান খালাসের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া তার সহযোগি অতিরিক্ত কমিশনানের দুর্নীতিতেও কোন ধরনের ব্যবস্থা নেন না তিনি। আর এই পণ্য চালান খালাসের ডকুমেন্টসে স্বাক্ষর রয়েছে এডিসি শরীফের। এরপরও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি কমিশনার।
বেনাপোলে দুর্নীতির বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, গত ২২ জানুয়ারি বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটের এমআর ইন্টারন্যাশনালের দুটি ট্রাক আটক করে বিজিবি। ট্রাকের পণ্য চালান ইনভেন্টরি করার জন্য বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে বিজিবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও শুল্ক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। এই চালানে অতিরিক্ত প্রায় ৬ হাজার ৫২৯ কেজি পণ্য পাওয়া গেছে।এমআর ইন্টারন্যাশনালের এই পণ্য চালানের মধ্যে নাট-বল্টু ৬ হাজার ৮০ কেজি, স্টার্টার মাইক্রো রিলে ১ হাজার ৫০০ পিস, ট্রাম্পেট জাম্বো ও প্লাস্টিক হর্ন পাইপ ২৪০ কেজি, লং হোস মিউজিক্যাল জাম্বো ১১০ কেজি, বেল্ট পোলি টিলন পাইপ ১৮ দশমিক ৮৯ কেজি এবং গিয়ার সিম সেট সিঙ্গেল মিনার ট্রেলার ২৮ কেজি ছিল। এছাড়া বিপুল পরিমাণ মেডিসিন ছিলো যা সরানো হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এ চালানটি বেনাপোল কাস্টম হাউসের শুল্ক কর্মকর্তারা শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করেই ছাড়পত্র দিয়েছেন। অর্থাৎ, পণ্যের মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুল্ক না নিয়েই খালাস করেছেন। এই পণ্য চালালে শুল্ক কর্মকর্তারা সবাই লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে চালানটিতে ঘোষণার বাইরে পণ্য থাকলেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে কমিশনার থেকে সবাই ঘুষ নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান।
আরও বলা হয়েছে, বিজিবি এই চালান আটক না করলে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি অজানাই থেকে যেত। এদিকে, মিথ্যা ঘোষণার চালানে উচ্চ শুল্কের ক্যান্সারের ওষুধ ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ চালানের ব্যাপারে রফাদফা হয়েছে, যার ফলে কাস্টমস কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে শুল্ক ফাঁকির সুযোগ দিয়েছেন। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান লাবিবা ট্রেড সেন্টারের স্বত্বাধিকারী রাকিব মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য আমদানির বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
অভিযোগে বিস্তর উল্লেখ করে আরও বলা হয়েছে, চালান ধরা পড়ার কারণে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। প্রশ্ন উঠছে, যেসব চালান শতভাগ কায়িক পরীক্ষা ছাড়াই ছাড়পত্র পাচ্ছে, সেগুলোতে কী পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে? রাজস্ব ফাঁকির আরও একটি পদ্ধতি হলো—দুই হুইলার পার্টসকে তিন বা চার হুইলার পার্টস হিসেবে দেখিয়ে শুল্কায়ন করা, যাতে কম শুল্ক গুনতে হয়। এতে সরকার যেমন বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি কী ধরনের পণ্য দেশে প্রবেশ করছে, তার কোনো নথিও থাকছে না।এর আগেও বেনাপোল কাস্টম হাউসে একাধিক আলোচিত ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্বর্ণ চুরি এবং ভায়াগ্রার চালান আটক। কিন্তু এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরও শুল্ক ফাঁকির অনিয়ম থামছে না।
দুদকে দায়ের করা অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার একদিকে শুল্ক-কর বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের নাকের ডগা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার পণ্য ছাড় করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি দেশের আমদানি বাণিজ্যের স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পরও যদি সাড়ে ৬ হাজার কেজির বেশি অতিরিক্ত পণ্য ধরা না পড়ে, তাহলে শুল্ক কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। বিজিবির তৎপরতায় ঘটনাটি ধরা পড়লেও, কাস্টমস কর্মকর্তাদের এই অবহেলার দায় কে নেবে? কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে এভাবে লুটে পুটে বন্দর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পণ্য আর লাভবান হচ্ছে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী সাথে শুল্কের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। চিঠিতে, এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টাকে অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো কামরুজ্জামানের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দিলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। একই সাথে কমিশনারের ব্যক্তিগত প্রটোকল অফিসার ইমরানকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, স্যারের ফোন বন্ধ। তিনি পরে এ বিষয়ে কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর) মো আবদুর রহমান খান বাংলাবার্তাকে বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে সত্যি সেটা দুঃখজনক। আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না। এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি এবং কি ঘটেছে সেটা জেনে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংষ্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বাংলাবার্তাকে বলেন, কাস্টমসে দুর্নীতির শেষ নেই। আমরা বারবার কাস্টমসের দুর্নীতি নিয়ে এনবিআরকে জানালেও তারা চুপ থাকে। যার কারণে একের পর এক দুর্নীতি হচ্ছে। দুদক এ বিষয়ে আরও কঠিন হতে পারে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কমিশনের উচিত সত্য বের করা।