
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা: পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বাস্তবায়নে নামকাওয়াস্তে নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখিয়ে লুটপাট করা হয়েছে ১৯০ কোটি টাকার বেশি অর্থ। মূলত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করে হরিলুটের এসব ঘটনা ঘটেছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সভা-সেমিনার। স্কুল-কলেজ পরিদর্শন, টিভিসি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাটের কুশীলবদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র তলব করেছে বলে জানা গেছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বাস্তবায়ন শীর্ষক গৃহীত প্রকল্পের নামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করার একটি অভিযোগ কমিশনে আসে। পরে সেটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনুসন্ধান টিমও গঠিত হয়েছে। তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। আশা করছি, তাদের দেওয়া অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিগত সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয় প্রচারণামূলক প্রকল্পে। এমন পাঁচটি প্রকল্প নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে। সেখানে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা সরাসরি খরচ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে। সভা-সেমিনার, স্কুল-কলেজ পরিদর্শন, টিভিসি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ, পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় করা হয় ওই টাকা। নামকাওয়াস্তে প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখিয়ে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
২.৯৮ লাখ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত, অবৈধ লেনদেন ৫০ হাজার কোটি ভুয়া তথ্য-ঘোষণায় বন্ড সুবিধার পণ্য যেভাবে চলে যায় খোলাবাজারে
প্রতারণার কৌশল হিসেবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা (একনেক) এড়াতে ৫০ কোটি টাকা করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সাধারণত এডিপির আওতায় ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে একনেকের অনুমোদন নিতে হয় না। কুশীলবরা এ সুযোগের অপব্যবহার করেন।
এভাবে গত চার বছরে ৫০ কোটি টাকার নিচে এমন পাঁচটি প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’। এসব প্রকল্পের কাজ মন্ত্রী ও সচিবের অভিপ্রায় অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হয়।
যেমন- ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি হাতে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্প। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। এতে খরচ ধরা হয় ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের অধীন গৃহীত কার্যক্রমগুলো হলো- বিভাগীয় পর্যায়ে সভা-সেমিনার, ৭ মার্চের ভাষণ সর্বজনবিদিত করা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখা, প্রচার, ফটোগ্রাফি, ডকুমেন্টেশন ইত্যাদি। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হাতে নেয় ‘নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণ’ প্রকল্প। যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২০ সালের শেষের দিকে। ৪৯ কোটি ২০ লাখ ১৪ হাজার টাকার এ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণের নিমিত্তে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর যেমন- বাস এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কর্মসূচি পালন। প্রকল্পের আওতায় দেখানো হয় প্রায় এক হাজার স্কুলে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা এবং নয়টি মুক্তির উৎসব ও ৬৩টি সেমিনার বাস্তবায়ন। অভিযোগ ওঠে, এ প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলের ছবি তুলে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়।
অপারেশন জ্যাকপট মুক্তিযুদ্ধের একটি গৌরবময় অংশ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হাতে নেয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তবে তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে এ চলচ্চিত্র নির্মাণকাজ শেষের দিকে। বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে তৈরি এ চলচ্চিত্র কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। চলচ্চিত্র নির্মাণে বিপুল ব্যয় দেখানো হলেও আদতে এ চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানে না সাধারণ মানুষ। কারণ, চলচ্চিত্রের পরিচালক থেকে শুরু করে যেসব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে চিত্রায়নে নেওয়া হয়, তারা কেউই শীর্ষ তারকা নন।
অন্যদিকে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে নেওয়া হয় বীরের কণ্ঠে ‘বীরগাথা’ শীর্ষক প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় যেসব মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন তাদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, সম্প্রচার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্মিলন ঘটানো, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে ই-আর্কাইভ স্থাপন। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪৯ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজার টাকা।
এ ছাড়া ২০২১ সালের জুন মাসে অনুমোদন পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্যানোরমা নির্মাণ প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধকে প্রদর্শনীর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চেতনা তুলে ধরার লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪৫ কোটি ২৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। অভিযোগ উঠেছে, প্যানোরমা নির্মাণ নয়, শুধু কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্যই নেওয়া হয় প্রায় ৪৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প।
এদিকে, গত ৫ মার্চ ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণ ও পুনর্র্নিমাণ’ প্রকল্পের নথি গায়েব করে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদকের পৃথক একটি টিম। অভিযানের সময় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক কামিয়াব আফতাহি-উন-নবীর নেতৃত্বে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এসজে