
হালখাতা
ঢাকা: প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল হালখাতা। গ্রামগঞ্জ-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষে পুরোনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় আগের জৌলুশ না থাকলেও ধুঁকে ধুঁকে এখনো টিকে আছে সেই ঐতিহ্য। বিশেষ করে পুরান ঢাকার আদি ব্যবসায়ীরা হালখাতা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও টিকে আছে কোনোরকমে।
মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে হালখাতা শুরু থেকেই নববর্ষের অপরিহার্য অংশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এখনো অল্পবিস্তর ধরে রেখেছেন হালখাতার ঐতিহ্য।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ, বাংলা ১৪৩২ সাল শুরু হয়েছে। পুরান ঢাকার যে ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন তারা জানিয়েছেন, করোনা মহামারি ও এরপর গত দু’বছর ঈদের ছুটির মধ্যে পহেলা বৈশাখ হওয়ায় সেভাবে হালখাতা করা যায়নি। এবার কিছুটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।
‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি– দুই ভাষায়ই রয়েছে। সংস্কৃতে ‘হাল’ অর্থ ‘লাঙল’, অন্যদিকে ফারসিতে ‘হাল’ অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। ঐতিহাসিকদের মতে, হালখাতার ইতিহাস কৃষিপ্রথার সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ কৃষিপ্রথার সূচনার পর হাল বা লাঙল দিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য বিনিময়ের হিসাব একটি বিশেষ খাতায় লিখে রাখা হতো, যেটি ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
‘হালখাতা’অনুষ্ঠানটি করতেন ব্যবসায়ীরা। ওই সময়ে ফসল বিক্রি করে হাতে সবার নগদ টাকা থাকতো। হাতে নগদ টাকা না থাকায় বাধ্য হয়েই সারা বছর বাকিতে জিনিসপত্র কিনতেন কৃষকরা। নববর্ষের সময় ফসল বিক্রি করে বকেয়া পরিশোধ করতেন। নতুন বছরে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন ব্যবসায়ীরা। সেই খাতা লাল কাপড়ে মোড়ানো। হালখাতা ঘিরে উৎসব জমে উঠতো। খাওয়াতো হতো মিষ্টি-মেঠাই।
নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা হালখাতা নিয়ে উৎসাহী নয়। নগদ টাকা হাতে থাকায় মানুষও আর আগের মতো সেভাবে বাকির ওপর নির্ভরশীল নয়। যেটুকু বাকি পড়ে তা নির্দিষ্ট সময়ে আদায়েও আগ্রহী নন ব্যবসায়ীরা। তাই তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ ও আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার দাপটে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে হালখাতার ঐতিহ্য ম্রিয়মান।
দেশের অনেক জেলায় হালখাতার প্রচলন থাকলেও তা আগের মতো নেই। আগে হালখাতা উপলক্ষে দোকান সাজানো হতো, খাওয়ানো হতো মিষ্টি। এসব আগের চেয়ে কমেছে। তবে স্বল্পপরিসরে হলেও টিকে আছে।
ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারী বাজার, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, চকবাজার, বাবুবাজার, বাদামতলীতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনো নববর্ষে হালখাতার প্রচলন রয়েছে।
পুরান ঢাকার নববর্ষের ঐতিহ্য বলতে পারেন এ হালখাতা। বিশেষ করে তাঁতীবাজার, শ্যামবাজার, চকবাজার, বাদামতলী, ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা এখনো হালখাতা করেন। এসব জায়গায় পুরোনো ব্যবসায়ীরা এখনো নিয়ম করে নববর্ষে হালখাতা করেন।
তাঁতি বাজারের কে বি গোল্ড হাউজের ম্যানেজার মিলন ঘোষ বলেন, ‘আগামী ১৪ ও ১৫ এপ্রিল দু’দিনই আমাদের হালখাতার অনুষ্ঠান রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী আমরা ১৪ এপ্রিল হালখাতা করি। আর ১৫ এপ্রিল সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হালখাতা ও পূজা দেওয়ার প্রোগ্রাম থাকে। কাস্টমাররা আসে, তাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়, উপহার দেওয়া হয়। হালখাতা উপলক্ষে দোকানে সাজসজ্জা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘হালখাতার দিন দেনাপাওয়া পরিশোধ হয়। ক্রেতারা নতুন করে লেনদেন করেন। সারা বছর যারা লেনদেন করেছে আমরা তাদের উপহার দেই।