ছবি সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট লডারডেলকে ফুটবল পাড়ায় চিনতেন ক’জন! ২০১৪ সালে এই অঞ্চলে এক নতুন ফুটবল ক্লাব আসে। ইংলিশ কিংবদন্তি ডেভিড বেকহামের হাত ধরে এই অঞ্চলে ফুটবলে প্রসার ঘটে। গড়ে ওঠে ইন্টার মায়ামি ফুটবল ক্লাব।
২০১৮ সালে হয় ১৮ হাজার ধারণক্ষমতার স্টেডিয়াম, তবুও ইন্টার মায়ামিকে চেনা যাচ্ছিল না। দেশটির লিগের তলানিতে জায়গা হয় ইন্টারের। এখন থেকে জ্বলে ওঠার একমাত্র উপায় ছিল এমন কাউকে নিয়ে আসা যার দ্যুতি ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। তার ছোঁয়ায় ভোজবাজির মতো মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে সব। ঠিক সেই কাজটাই করে ফেললেন ডেভিড বেকহাম। নিজের দলকে বিশ্বজোড়া আলোচনায় নিয়ে আসতে নিয়ে এলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলারের একজন লিওনেল মেসিকে।
সামনের মৌসুমটায় এই লডারডেলের ১৮ হাজার ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে নামবেন মেসি। ৯০ হাজারের ক্যাম্প ন্যু, প্রায় ৫০ এর পার্ক দে প্রিন্সেস থেকে মেসিকে দেখার সুযোগ এখন মাত্র ১৮ হাজারের! নাহ, ক্লাবের নাম জ্বলল বটে এবার গ্যালারি বাড়াতে হবে বেকহামকে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার (এমএলএস) এখন সত্যিই আলোকিত। সেই ২০০৭ সালে দেশটির ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে এসেছিলেন বেকহাম। যার আগমনে বাস্কেটবল, বেসবল, টেনিস ও অ্যাথলেটিকসের যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের আলোড়ন ওঠে। এই কিংবদন্তির পদাঙ্ক অনুসরণে সময়ের সঙ্গে অনেক নামি ফুটবলার ভিড় বাড়িয়েছেন এমএলএসে। তবুও কিছুর যেন একটা অভাব ছিল।
সেই অভাব মেটাতে এমএলএসকে আরও আলোকিত করতে এগিয়ে এলেন বেকহামই। তার হাত ধরে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি এসে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল পাড়ায়। বিশ্ব রাজনীতির একক আধিপত্য ছড়ানো শক্তি হয়েও ফুটবলে খুব বড় কিছু হয়ে উঠতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র। প্রতি বিশ্বকাপেই বড় নাম করে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। ফুটবলের সঠিক জোয়ারের অভাবে ফিফা বিশ্বকাপে দেশটির এই দশা। বিশ্বজয়ী মেসির আগমনের প্রভাবে এই দশা দূর হবে হয়তো!
বেকহাম বা ইন্টার মায়ামির মেসিকে নেওয়ার চেষ্টা আজকের নয়। ২০১৪-তে গঠন হওয়ার পর থেকেই দলের নাম বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে সেরা একজনকে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল বেকহামের। ২০১৮-তে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবের পথচলা শুরু হয় তখন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তিকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মেসি।
২০২১ সালে মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার খবরে সবার প্রথমে মেসির এজেন্ট তার বাবা হোর্হে মেসিকে ফোন করেছিলেন বেকহামই। কিন্তু ওই সময় পরিস্থিতির কারণেই বেকহামের প্রস্তাব নিতে পারেননি মেসি। সাত বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী চলে যান পিএসজিতে, যেখানে একসময় খেলেছিলেন বেকহাম। তিনি জানতেন বয়সের সঙ্গে একসময় মেসিকেও এগোতে হবে। ইউরোপিয়ান ফুটবলের গতিময় মঞ্চ ছেড়ে মেসিকে যেতে হবে অন্য কোথায়। তাই মেসির পিছু ছাড়েননি বেকহাম। এপ্রিলে উপস্থিত হয়েছিলেন পিএসজির অনুশীলনে। সেখানে মেসির সঙ্গে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল ছিল।
বিশ্বকাপের পরপরই মেসির সঙ্গে পিএসজির সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। ঠিক ওই সময় মেসিকে তার ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তাবটা দিয়ে থাকতে পারেন বেকহাম নিজেই।
ইন্টার মায়ামি আসলে শুরু থেকেই ধরে নিয়েছিল একদিন মেসি তাদের হবেন। তাই মেসিকে তুলে আনা বার্সেলোনা কর্মকর্তাদের নিয়ে নিজেদের ডেরায় চাকরি দিতে থাকে। বার্সেলোনার প্রধান বিজনেস অফিসার জাভি অ্যাসেনসি এখন ইন্টার মায়ামির। আরেকজন সাবেক বার্সা কর্মকর্তা ভিক্টর অলিভার এখন ক্লাবটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি খবর ছড়িয়েছে সাবেক বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনা কোচ টাটা মার্টিনেজকে আগামী মৌসুমে কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেবে ইন্টার মায়ামি। এছাড়া সবচেয়ে আলোচনার খবর হলো দলটি সার্জিও বুসকেতস, জর্দি আলবা ও লুইস সুয়ারেজদের টানার চেষ্টায় অনেকদূর এগিয়েছে। যা সবশেষে মেসি ও তার বন্ধু একাদশে রূপ নিতেই পারে!
মেসির ইন্টার মায়ামিতে আসায় আরেক বিষয় স্পষ্ট। এখন আর ১৮ হাজারের ফোর্ট লডারডেল দলটির হোম ম্যাচের ভেনু হচ্ছে না। বরং ফ্লোরিডার সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম হার্ড রক স্টেডিয়াম হয়ে যাবে ইন্টারের হোম ভেন্যু। যার ধারণক্ষমতা ৬৫ হাজারের বেশি। এ মাঠে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফুটবল ও কোপা আমেরিকার ম্যাচ হয়েছে নিয়ম করেই। সামনে আগস্টে তাই আর পিংক স্টেডিয়াম নয়, ইন্টারকে খেলতে হবে হার্ড রকে।
অবশ্য মেসির সঙ্গে ইন্টারের এই চুক্তি অবশ্য শুধু ক্লাব ও খেলোয়াড়ের ব্যাপারই নয়। জানা গেছে খোদ মেজর লিগ সকার কর্র্তৃপক্ষ এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা করেছে ইন্টারকে। তাদের বিশ্বাস ১৬ বছর আগে এমএলএসকে যে শুরুটা এনে দিয়েছিলেন বেকহাম। তার ক্লাবের মাধ্যমে মেসির পায়ে এমএলএসের নতুন দিগন্তের শুরু হবে।
শুধু এটুকুই নয়, বেকহাম যোগ দেওয়ার পর এমএলএসে দল সংখ্যা ১৩ থেকে বেড়ে হয়েছিল ২৯। ২০২৫ থেকে ৩০তম দল যোগ দেবে এমএলএসে। বেকহাম যোগ দেওয়ার পর লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সির জার্সি এক মৌসুমে বিক্রি হয়েছিল ৩ লাখ পিস। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল- বাস্কেটবল সদৃশ বল নিয়ে শরীরীশক্তি প্রদর্শনের ফুটবল), বাস্কেটবল তারকাদের পাশাপাশি লেট নাইট টিভি শোতে উঠত বেকহামের কথা। তার ওই তারকা খ্যাতি ছাড়া দেশটিতে ফুটবলের এই প্রসার সম্ভব হতো না। সেই জাগরণ এখন লিওনেল মেসির মাধ্যমে আরও ত্বরান্বিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।
মেসি এমএলএসে আসায় সবচেয়ে বড় যে লাভটা যুক্তরাষ্ট্রের হলো তা হচ্ছে বিশ্বকাপ। ২০২৬ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা এখনই করে ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। কানাডা, মেক্সিকোকে নিয়ে যৌথ আয়োজক হলেও যুক্তরাষ্ট্র মেসিকে টেনে একেবারে লাইমলাইটে চলে এসেছে। এখন মেসিও ইন্টার মিয়ামিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ২০২৬ বিশ্বকাপে মাঠে নামার প্রস্তুতি সেরে রাখতে পারেন।
(ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের গ্রাহাম রুথভেনের লেখা থেকে)