লিওনেল মেসি
আজ ছত্রিশ বছরে পা রাখলেন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি। শুভ জন্মদিন জীবন্ত কিংবদন্তি। আজকে এই শুভক্ষণে তোমার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
ফুটবল আর মেসির জীবন এতটাই একসূত্রে গাঁথা যে আবেগের দুটো স্রোত কখন মিলেমিশে এক হয়ে যায়, সেটা ঠিক ঠাহর করা যায় না। কাতার বিশ্বকাপে অজস্র মানুষ গিয়েছিলেন মেসির কাছে জমে থাকা ফুটবলের অনেক ঋণ শোধের সাক্ষী হতে। মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে। নাটকীয় ফাইনালের পর পিটার ড্রুরি তার মায়াবী কণ্ঠে যখন বলে উঠেছিলেন, ‘স্বর্গের শেষ সিঁড়ি ভেঙে মেসি হাত মিলিয়েছেন অনন্তের সঙ্গে’, তখন যেন পূর্ণতা পেয়েছিল ফুটবল খেলাটাই। মেসি যদি ফুটবল না খেলতেন তাহলে কেমন হতো পৃথিবীটা?
স্রেফ কল্পনার খাতিরেই ধরে নেওয়া যাক, হোর্হে মেসি আর সেলিয়া দম্পতির তৃতীয় সন্তান কখনো ফুটবলে লাথি মারেননি। রদ্রিগো আর মাতিয়াসের পর হোর্হে-সেলিয়া দম্পতির তৃতীয় সন্তান লিওনেলের ভেতর ছোটবেলা থেকেই ছিল কিছু শারীরিক সমস্যা। বয়স আন্দাজে ঠিক বাড়বাড়ন্ত লাগছিল না ছোট্ট লিওকে। বয়স যখন ১০, তখন তার ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিশিয়েন্সি’ ধরা পড়ে। হোর্হে তখন একটা ইস্পাত কারখানার ম্যানেজার, বেতনের সঙ্গে পাওয়া স্বাস্থ্য বীমায় এই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া গেছে মাত্র দুই বছরের জন্য। এরপর?
মেসি যদি ফুটবল না খেলতেন, তাহলে হয়তো চিকিৎসা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারত না মেসির পরিবার। সে ক্ষেত্রে কী হতে পারত ছোট্ট লিওর ভবিষ্যৎ? বয়স অনুপাতে শরীর বাড়ত না, দ্রুত চুল পড়ে যেত, অকাল বার্ধক্য দেখা দিত আর ধীরে ধীরে শরীরে ভর করত নানান রোগ-ব্যাধি। এই সবকিছুর সঙ্গে যোগ হতো সামাজিক অবহেলা। সবকিছু মিলিয়ে হোর্হে আর সেলিয়া দম্পতির তৃতীয় সন্তানটি খুব দীর্ঘায়ু লাভ করত, এমনটা মনে হয় না। এখানে আরও মনে রাখতে হবে, মেসির বেড়ে ওঠার সময় আর্জেন্টিনায় অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। যার প্রভাব পড়ে সব ক্ষেত্রেই। তখন পরিবার অথবা রাষ্ট্র কোনো তরফেই শারীরিকভাবে দুর্বল এমন কারও দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়াটা হতো কঠিন।
এখানেই মেসিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ফুটবল। আপন দুই ভাই আর দুই তুতো ভাইয়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতেন মেসি। চার বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলিতে অনুশীলন শুরু করে ক্ষুদে লিও, বাবা হোর্হে সেখানে ছিলেন কোচের ভূমিকায়। তবে মেসির ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা গাঢ় করে তুলেছিলেন তার নানি। ছোট লিওকে খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসার কাজটা করতেন নানি সিলিয়া। এ জন্যই তো এখনো গোল করে আকাশে সেই প্রিয় মুখটা খুঁজে বেড়ান ফুটবলের জাদুকর।
স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলি থেকে নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুব দলে যোগ দিল ছোট্ট লিও, সেখানে ছোটদের লিগে প্রায় ৫০০ গোল করে ফেলল সে। শুধু তা-ই নয়, বড়দের ম্যাচেও হাফটাইমে সে বল নিয়ে কলাকৌশল দেখাত। অল্পদিনেই ক্ষুদে প্রতিভা হিসেবে বেশ একটা নাম হয়ে গেল হোর্হের তৃতীয় ছেলের। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ইউরোপের ক্লাবের স্কাউটরা সব সময় সতর্ক চোখ রাখে প্রতিভা অন্বেষণে, লিওনেলের কথা জানতে বাকি নেই তাদেরও। তবে প্রথমে মেসির সঙ্গে যোগাযোগ করল আর্জেন্টিনারই শীর্ষ ক্লাব রিভারপ্লেট, যেখানে তখন খেলতেন মেসির এক সময়ের আইডল পাবলো আইমার। কিন্তু মেসির স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা শুনে তারা পিছু হটল। মেসিদের পরিবারের কিছু আত্মীয়স্বজন থাকতেন কাতালোনিয়ায়। তাদের মাধ্যমেই ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে বার্সেলোনায় মেসির একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মেসির খেলা দেখে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ফার্স্ট টিম ডিরেক্টর কার্লেস রেক্সাচ মুগ্ধ হয়ে তাকে দলে নিতে চান। কিন্তু সে সময় মেসির পরিবার স্রেফ মৌখিক প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি কিছু চাইছিল আর ইউরোপের ক্লাবগুলোও স্রেফ একটা ১৩ বছরের বিদেশি কিশোরের জন্য এত কাঠখড় পোড়াতে চাইছিল না। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ঘটে সেই বিখ্যাত ঘটনা, হাতের কাছে কাগজ না পেয়ে ন্যাপকিনে বার্সেলোনায় মেসিকে সই করিয়েছিলেন রেক্সাচ। মেসির চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিল বার্সেলোনা। এই একটা ঘটনাই মেসির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
মেসি ফুটবলটা অসাধারণ ভালো খেলতেন বলেই জটিল রোগে আক্রান্ত এক বিদেশি কিশোরের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিল বার্সেলোনার মতো ক্লাব। একদিন অনেক অনেক গোল করবেন আর অনেক শিরোপা জেতাবেন, এই বিশ^াসেই মেসি আর তার পুরো পরিবারকে স্পেনে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি। লা মাসিয়ার সেই খামারবাড়িতে প্রথম বছরটা কষ্টে কাটে মেসির, একে তো পরিবার থেকে দূরে আর দ্বিতীয়ত চুক্তি জটিলতায় প্রীতি ম্যাচ ছাড়া খেলানো যাচ্ছিল না মেসিকে। এতটাই বিমর্ষ থাকতেন যে অনেকেই তাকে ভেবেছিল বাকশক্তিহীন।
মেসি যে বার্সেলোনার জন্য কত বড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন, সেটা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। ১৮তম জন্মদিনে মেসি প্রথম পেশাদার চক্তি সই করেন, বার্সেলোনার প্রথম দলের খেলোয়াড় হিসেবে তার চুক্তি ছিল ২০১০ পর্যন্ত। বাই-আউট ক্লজ ছিল দেড়শ মিলিয়ন ইউরোর। বার্সেলোনা এখন পর্যন্ত ২৭ বার জিতেছে লা লিগা, মেসি দলে নিয়মিত হওয়ার পর নয়বার। মেসি আসার আগে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ছিল মাত্র একটি, ১৯৯১-৯২ মৌসুমে। মেসি আসার পর কাতালানরা ইউরোপসেরা হয়েছে চারবার। এ তো স্রেফ সংখ্যার হিসাব। মেসির জাদুতে অযুত-নিযুত ভক্ত বেড়েছে বার্সেলোনার, পেপ গার্দিওলার পক্ষে সম্ভব হয়েছে স্বপ্নের দল গঠনের যে দলটা ফুটবলে নতুন সৌন্দর্য আর দর্শনের অবতারণা করেছে।
অধরা বিশ্বকাপটা ২০১৪ সালে হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকে গেলেও ২০২২ সালে ঠিকই করায়ত্ত করেছেন মেসি। মরুভূমির বুকে তারার আলোয় ফুটবলের কালপুরুষ হাতে তুলে নিয়েছেন আরাধ্য সেই সোনালি স্মারক। শুধু আর্জেন্টিনারই ৩৬ বছরের আক্ষেপ দূর করেননি মেসি, স্বপ্ন পূরণ করেছেন অগুনতি সব ফুটবল ভক্তেরও, যারা রাতের পর রাত জেগেছেন জাদুকরের ইন্দ্রজালে।