
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও আলোচিত খেলোয়াড়দের একজন সাকিব আল হাসান। খেলার মাঠে একের পর এক রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি গত এক দশকে তিনি নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তার রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হয়, যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সৃষ্টি করে ব্যাপক আলোড়ন ও বিতর্ক।
তার রাজনীতিতে যোগদানের সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিভিন্ন মহলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ একে সাকিবের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন, আবার কেউ বা একে তার ক্যারিয়ারের এক অনাকাঙ্ক্ষিত মোড় বলে মনে করেন। তবে সময় যতই গড়িয়েছে, পরিস্থিতি যতই জটিল হয়েছে, সাকিব আজও তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পক্ষে অনড়।
সম্প্রতি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক The Daily Sun-এর সাংবাদিক জাইগুম আজম-কে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে সাকিব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “আমি এখনও মনে করি রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত আমার জন্য সঠিক ছিল।” এই বক্তব্য শুধু একটি ব্যাক্তিগত প্রতিক্রিয়াই নয়, বরং তা একদিকে তার আত্মবিশ্বাস, অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের এক ইঙ্গিতবাহী বার্তা হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
দেশে ফেরা হয়নি, কাঁটায় মোড়ানো সময়
২০২৩ সালের জুলাই মাসে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিতে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন সাকিব। এরপর দেশে আর ফেরা হয়নি। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর নতুন সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় একের পর এক মামলা, যার মধ্যে অন্যতম ছিল হত্যাচেষ্টার অভিযোগ, শেয়ারবাজারে অনিয়ম, এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের উদ্যোগ।
এই দুঃসময়ে তিনি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আর মাঠে নামতে পারেননি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসর নেওয়া সাকিবের পরিকল্পনা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নিয়ে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানা। তবে সবকিছু স্থগিত হয়ে যায়।
রাজনীতিতে যোগদান প্রসঙ্গে সাফ বক্তব্য
সাক্ষাৎকারে সাকিব বলেন, “যদি আমি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য ভুল করে থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে যেই-ই আসুক না কেন, সেও ভুল করবে।” তার মতে, রাজনীতি একটি নাগরিক অধিকার এবং যে কেউ নিজেকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করতে পারে।
তিনি বলেন, “আমার উদ্দেশ্য ছিল মাগুরার মানুষের জন্য কাজ করা। আমি বিশ্বাস করি, তারা আমাকে চায়। আমি যখন দাঁড়িয়েছিলাম, তখন একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল এবং আমি নিশ্চিত আমি যদি আবার দাঁড়াই, তাহলেও আমি জিতব।”
স্থানীয় মানুষের প্রতি আত্মবিশ্বাস
সাকিব বিশ্বাস করেন তার রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্তের সমালোচনায় যারা সরব, তারা মাগুরার ভোটার নন। তিনি বলেন, “যারা আমার সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মনে করেন, তাদের অনেকেই আমার নির্বাচনী এলাকার ভোটার নন। মাগুরার মানুষ আমাকে চায়, এবং সেটাই আমার আত্মবিশ্বাসের উৎস।”
তিনি আরও বলেন, “আমি যদি সিস্টেমের ভেতরে না যাই, তাহলে কীভাবে সেই সিস্টেম পরিবর্তন করব? আমার উদ্দেশ্য ছিল জনসেবা করা, এবং আমি বিশ্বাস করি সেই জায়গা থেকে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।”
ক্রিকেট ছাড়ার পরিকল্পনা এবং শেখ হাসিনার পরামর্শ
সাকিব জানান, তিনি সবসময় চেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চ থেকে দেশের মাটিতে বিদায় নিতে। তবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছিলেন—‘তোমার রাজনীতি করার দরকার নেই; শুধু ক্রিকেটে মনোযোগ দাও’। আমি তার পরামর্শ অনুযায়ী চলেছি।”
সাকিব দাবি করেন, তিনি খুব সহজেই রাজনীতি করে যেতে পারতেন, তবে সেটি করেননি কারণ তার প্রথম অগ্রাধিকার ছিল ক্রিকেট। তার পরিকল্পনা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে বিদায় নেওয়া, এরপর ধাপে ধাপে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, বললেন সাকিব
রাজনীতির পালাবদল এবং ক্ষমতা পরিবর্তন প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, “কেউই চিরকাল ক্ষমতায় থাকে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারাও এক সময় থাকবে না। চক্রের মতো এটি চলতে থাকে।”
তিনি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও নিজেকে একজন সম্ভাব্য ফেরার প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন এবং বলেন, “আমি মনে করি এখনও অন্তত এক বছর বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলার সামর্থ্য আমার আছে। যদি সেই সুযোগ আসে, আমি অবশ্যই খেলতে চাই। প্রয়োজনে আমি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলাপ করতেও প্রস্তুত।”
সাকিব আল হাসানের এই সাক্ষাৎকার শুধু একজন ক্রিকেটারের রাজনীতিতে যোগদানের আত্মপক্ষ সমর্থন নয়, বরং এটি এক ধরনের আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার ইঙ্গিত।
দেশের ক্রিকেট ও রাজনীতির ইতিহাসে এমন সাহসী পদক্ষেপ আর কেউ নিয়েছেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সাকিব তার অবস্থান থেকে সরেননি। বরং তিনি মনে করেন সময়ের বিচারে একদিন তার সিদ্ধান্তের পেছনের যুক্তিগুলো সবাই বুঝতে পারবে। এখন দেখার বিষয়—সাকিব আরেকবার জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ পান কিনা, কিংবা রাজনীতিতে ফিরে নিজের প্রতিশ্রুত কাজগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ আসে কিনা। সময়ই সেই উত্তর দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ