
ছবি: সংগৃহীত
সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের চোখে তিনি কিংবদন্তি, যিনি শুধু খেলেন না—খেলাটাকেই সৌন্দর্যের রূপ দেন। তিনি লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, ফুটবল ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়। কাতারে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ জয় করে স্বপ্নপূরণ করেছেন, অর্জন করেছেন প্রায় সবকিছু। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—তিনি কি খেলবেন ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে?
এবার সেই আলোচনার নতুন অধ্যায় খুললেন মেসি নিজেই। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি আবারো আশার আলো দেখালেন, তবে শর্ত রেখেই।
সৎ থাকা, সময়কে অনুভব করা—এভাবেই ভাবছেন মেসি
‘সিম্পলিমেন্টে ফুটবল’ নামের একটি ফুটবল ভিত্তিক অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসি জানান, তিনি চান ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলতে, তবে নিজের কাছে সৎ থেকে। তিনি বলেন,
“২০২৬ বিশ্বকাপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার জন্য এই বছরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই, আমি বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছি এবং দলের সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু আমি দিন ধরে ধরে এগোচ্ছি। আমি বিশ্বকাপে খেলতে পারবো কিনা, এ বিষয়ে আমাকে নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে।”
মেসির কথার মর্মার্থ পরিষ্কার—তিনি বিশ্বকাপে খেলবেন কিনা, সেটি নির্ভর করছে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর। যদি মনে হয় তিনি দলের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবেন এবং কারো জন্য বোঝা হবেন না, তবেই মাঠে নামবেন।
বয়স বাড়ছে, কিন্তু মনের তাড়না থেমে নেই
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামি ক্লাবে খেলছেন মেসি। ২০২৪ সালের জুনে তাঁর বয়স হবে ৩৮ বছর, আর ২০২৬ বিশ্বকাপ শুরু হবে তাঁর বয়স ৩৯ পূর্ণ হওয়ার কিছুদিন পরেই। এই বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে শারীরিকভাবে ফিট থাকা এবং প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে দলের শীর্ষ ভরসা হয়ে ওঠা কঠিন।
তবে যে মেসিকে বিশ্ব চিনে ‘ফেনোমেনন’ হিসেবে, তাঁর জন্য এসব বয়স শুধুই সংখ্যা। মেসি এখনো ক্লাব ফুটবলে অসাধারণ পারফরম্যান্স করছেন, গোল করছেন, অ্যাসিস্ট দিচ্ছেন এবং নিজের দলের প্রাণভোমরা হয়ে আছেন।
তবুও তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে দায়িত্বশীল মন্তব্য করলেন, একেবারে তারকা-কেন্দ্রিক নয়, বরং দলের প্রেক্ষাপটেই নিজেকে মূল্যায়ন করছেন।
ফাইনালের ব্যথা, বিশ্বকাপের পরিপূর্ণতা—দুইয়ের মাঝেই মেসি
সাক্ষাৎকারে মেসি ফিরে যান ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। যেখানে তাঁর নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দারুণ ফুটবল খেললেও, অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোটজের গোলে হেরে যায় জার্মানির কাছে। মেসির জন্য সেটি ছিল এক অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা।
তিনি বলেন, “এমবাপ্পে ফাইনালে চার গোল করেছে (টাইব্রেকারসহ), তবু সে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এটা পাগলাটে মনে হবে। যদিও সে ২০১৮ বিশ্বকাপ জিতেছে, তার একটা স্বান্তনা আছে। একই ঘটনা ২০১৪ বিশ্বকাপে আমার সঙ্গে ঘটেছিল, ওই বিশ্বকাপ ছিল আমার জন্য মানসিক যন্ত্রণার। আপনি এখনো ভাবতে পারেন, আমার দুটো বিশ্বকাপ শিরোপা থাকতে পারত।”
এই কথাগুলোয় মেসির অতীতের বেদনা, বর্তমানের তৃপ্তি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন—সব একসাথে ধরা দেয়।
ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা, অর্জনের পূর্ণতা
তবে শেষ কথা বলতে গিয়ে মেসি থামেন নিজের পূর্ণতাবোধে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপে কাপ জিতে শেষমেশ বিশ্বকাপ-খরার অবসান ঘটিয়েছেন তিনি। এই অর্জন নিয়ে মেসি বলেন,
“আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু বিশ্বকাপটা ছিল না। সেটাও জিতেছি। ফুটবলে সম্ভাব্য সবকিছুই অর্জন করেছি আমি। এটা বলতে পারা খুবই মূল্যবান অর্জন। আমি সবসময় বলি, ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে কৃপা করেছেন, সবকিছু দিয়েছেন।”
এই আত্মতৃপ্তি এবং কৃতজ্ঞতা বোঝায়, মেসির কাছে ফুটবল শুধুই ট্রফি জেতার খেলা নয়—এটা তাঁর জীবনের সাধনা।
আর্জেন্টিনার জন্য নতুন প্রজন্মের সেতুবন্ধ?
বিশ্লেষকদের মতে, যদি মেসি ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিজের ফর্ম বজায় রাখতে পারেন, তবে তিনি হয়তো মাঠে উপস্থিত থাকবেন শুধুমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে নয়, বরং আর্জেন্টিনার তরুণ প্রজন্মের অভিভাবক ও অনুপ্রেরণা হিসেবেও। এভাবে ভবিষ্যতের তারকাদের তৈরি করার পথে তাঁর অভিজ্ঞতা একটি অনন্য সম্পদ হয়ে উঠবে।
একটা প্রতীক্ষা, একটা আশার আলো
বিশ্বকাপ মানেই আবেগ, আর মেসি মানেই ফুটবলের সেরা আবেগের প্রতিচ্ছবি। তাই ২০২৬ বিশ্বকাপে তাঁকে দেখতে চায় কোটি কোটি ভক্ত।
তবে সেই সিদ্ধান্ত একমাত্র তাঁরই। এবং তিনি সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সময় নিয়ে, নিজের শরীর, মন, এবং সততার আয়নায় নিজেকে প্রতিনিয়ত পরখ করে।
ফুটবল বিশ্বের জন্য এটি যেন এক ধরনের প্রতীক্ষা—আরও একবার মেসিকে বিশ্বকাপে দেখার প্রতীক্ষা।
এমন এক কিংবদন্তিকে শেষবার বিশ্বমঞ্চে দেখা কি সত্যিই সম্ভব হবে? উত্তর সময় দেবে। তবে এখনই জানা গেল—মেসির হৃদয়ে সেই সম্ভাবনা এখনও জ্বলছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ