
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের পর বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন যখন প্রায় ফিকে, তখন ভাগ্য যেন ঠিকই মঞ্চে হাজির হয়ে এক অবিশ্বাস্য নাটকের চিত্রনাট্য লিখল। ভরসা ছিল ক্ষীণ এক সম্ভাবনায়—ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি থাইল্যান্ডকে হারালেও নির্দিষ্ট ওভারের মধ্যে জয় নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলেই খুলে যাবে বিশ্বকাপের মূল পর্বের দরজা। আর ঠিক সেটাই হলো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জয় না পাওয়ায় ক্যারিবিয়ানদের সামনে বন্ধ হয়ে গেল ভারত বিশ্বকাপে খেলার পথ, অন্যদিকে উল্লাসে ভাসল টাইগ্রেসরা।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ উইকেটের হার মানে বাংলাদেশের। এতে করে ৫ ম্যাচে ৩ জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম থাইল্যান্ড ম্যাচের ফলাফলের দিকে।
অন্যদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থান ছিল এমন—তাদের থাইল্যান্ডকে শুধু হারালেই চলবে না, করতে হবে সেটা নির্দিষ্ট এক ওভারের মধ্যেই। কারণ, বাছাইপর্বে মূল লড়াইটা পয়েন্টের চেয়েও ছিল নেট রান রেট (NRR)-এর ওপর।
থাইল্যান্ডকে হারিয়েও বিশ্বকাপ হাতছাড়া ক্যারিবিয়ানদের
থাইল্যান্ডের দেওয়া ১৬৭ রানের লক্ষ্য পেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী দল মাঠে নামে এক রীতিমতো অভিযান নিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল এই রান তাড়া করতে হবে মাত্র ১০ ওভারের মধ্যে—মানে ৬০ বলের মধ্যে জয় ছিনিয়ে আনলেই বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে মূলপর্বে জায়গা করে নেওয়া যেত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ও ওপেনার হেইলি ম্যাথুস খেলেন অসাধারণ এক ইনিংস—মাত্র ২৯ বলে ৭০ রান, যার মধ্যে ছিল ১১টি চারের সঙ্গে দুটি বিশাল ছক্কা। তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন চিনেল হেনরি, যিনি মাত্র ১৭ বলে ৪৮ রান তোলেন, তিনটি চার ও পাঁচটি ছক্কার দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনীতে।
এই দুই ব্যাটারের তাণ্ডবে মনে হচ্ছিল, হয়তো সত্যিই থ্রিলার সিনেমার মতো শেষটা ক্যারিবিয়ানদের পক্ষেই যাবে। কিন্তু বিধি বাম—লক্ষ্য স্পর্শ করতেই তাদের লাগে ১০ ওভার ৫ বল, মানে পাঁচ বল বেশি। আর সেই অতিরিক্ত পাঁচ বলেই চলে আসে ছিটকে পড়ার রায়।
নেট রান রেটেই স্বপ্ন পূরণ বাংলাদেশের
বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দলই শেষ পর্যন্ত ৫ ম্যাচে ৬ পয়েন্ট করে অর্জন করে। কিন্তু পার্থক্য গড়ে দেয় সেই নেট রান রেট।
বাংলাদেশের নেট রান রেট: +০.৬৩৯
ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেট রান রেট: +০.৬২৬
এই সূক্ষ্ম ব্যবধানেই বাংলাদেশ আবারও বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়। ক্যারিবিয়ানরা জয় পেয়েও ফিরে যায় মূল পর্বের দরজার কাছ থেকে।
বাছাইপর্বে টাইগ্রেসদের পথচলা
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুর্দান্ত শুরু করেছিল বাংলাদেশ দল।
প্রথম তিন ম্যাচে জিতেছিল টানা—বিপক্ষ ছিল হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং থাইল্যান্ড।
এরপর হোঁচট খায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে।
তবে এই পরাজয়েও তারা ৬ পয়েন্ট অর্জন করে শেষ করে গ্রুপ পর্ব, এবং অপেক্ষায় থাকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারফরম্যান্সের ওপর। শেষ পর্যন্ত নিয়তি হেসে দেখে বাংলাদেশের দিকেই।
ভারতের মাটিতে বসছে নারী বিশ্বকাপের আসর
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে আইসিসি নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এই বিশ্বমঞ্চে খেলার সুযোগ পেয়েছে মোট আটটি দল। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাম এখন গর্বভরে উচ্চারিত হচ্ছে।
বিশ্বকাপ খেলবে যেসব দেশ:
ভারত (আয়োজক)
অস্ট্রেলিয়া
ইংল্যান্ড
নিউজিল্যান্ড
দক্ষিণ আফ্রিকা
শ্রীলংকা
পাকিস্তান
বাংলাদেশ
দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশের মেয়েরা
নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশের এটি দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেওয়া। প্রথমবারের মতো তারা খেলেছিল ২০২২ সালের নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে, যেখানে সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও তাদের পারফরম্যান্স প্রশংসা কুড়িয়েছিল ক্রিকেটবিশ্বে।
এবারের মিশন তাই আরও গুরুত্বপূর্ণ। শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুতি ও মানসিক দৃঢ়তা—দুটোই চাই। তবে বর্তমান দলটির ভেতরে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই, এমনটিই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
প্রতিক্রিয়া ও উচ্ছ্বাস
ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি বলেন,
“আমরা চেয়েছিলাম নিজেদের হাতে সুযোগটা রাখতে, সেটা পারিনি। কিন্তু আজকের ফল আমাদের প্রতি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিশ্বকাপের মঞ্চে আবারও বাংলাদেশ নামটি দেখতে পাওয়াটা গর্বের।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যে ভক্তদের উচ্ছ্বাসে ভেসেছে “#TigressesInWorldCup” হ্যাশট্যাগ। ক্রিকেট বোর্ড থেকেও মেয়েদের এই সাফল্যে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
এ যেন শুধু একটি ক্রিকেট ম্যাচের ফল নয়—এটা ছিল এক রুদ্ধশ্বাস নাটকের পর সত্যি হয়ে যাওয়া স্বপ্ন। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল আবারও দেখিয়ে দিল, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মানসিকতা ও একটু ভাগ্যের সহায়তা কীভাবে ইতিহাস গড়তে পারে। ভারতের মাটিতে এবার লাল-সবুজের মেয়েরা তৈরি নতুন চমক দেখানোর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ