
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত তারকাদের একজন, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এখন দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের মুখে পড়েছেন। অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থপাচার, এবং শেয়ারবাজারে অনিয়মসহ নানা অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যা ২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে।
বিশ্বমঞ্চে ক্রিকেট প্রতিভার জন্য প্রশংসিত হলেও সাকিব আল হাসান বারবার বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রস্তাব গোপন করে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন, আবার কখনো অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের প্রচারে অংশ নিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। সর্বশেষ, শেয়ারবাজারে একাধিক কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় তার নাম উঠে আসে—যার ফলে আবারও খবরের শিরোনামে এই তারকা।
এবার তাকে ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (BSEC) চিঠি পাঠিয়ে সাকিবের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক লেনদেন, শেয়ার মালিকানা, বিনিয়োগ ও আয়-ব্যয়ের খতিয়ান চেয়েছে দুদক। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তদন্ত আরও বিস্তৃত হবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অনুসন্ধানের দায়িত্বে রয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মাহবুবুল আলম এবং সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান। তারা সাকিবের বিপুল সম্পদ, কোম্পানি মালিকানা, বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগসহ যাবতীয় অনিয়ম খতিয়ে দেখবেন।
এ প্রসঙ্গে ৬ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, “সাকিবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, পরিস্থিতির ভিত্তিতে তিনি হয়তো দুদকের আসামিও হতে পারেন।” তার এই মন্তব্যের পরপরই দেশের ক্রিকেট মহল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পটভূমি দীর্ঘ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
-
জুয়াড়িদের তথ্য গোপন করে আইসিসির নিষেধাজ্ঞা
-
অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ
-
ব্যবসায়ী পরিচয়ে শেয়ারবাজারে একাধিক কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ
-
মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে শেয়ার কারসাজির অভিযোগ
-
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরও বাণিজ্যিক স্বার্থের সংঘাত
বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মাগুরা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর, সাকিবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়িক প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ উঠে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তিনি তার জনপ্রিয়তা ও সাংসদ পরিচয় ব্যবহার করে নিয়মের তোয়াক্কা না করে একের পর এক ব্যবসায়িক সুবিধা নিচ্ছেন।
সাবেক দুদক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সাকিবের এই পরিণতি বিশেষভাবে বেদনাদায়ক বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এক সময় দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণার মুখ ছিলেন তিনি, সেই ব্যক্তি এখন দুর্নীতির অভিযোগে রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধানের আওতায়।
দুদকের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, সাকিবের ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়, ব্যাংক লেনদেন, কোম্পানি নিবন্ধন, শেয়ার লেনদেন, বিদেশে টাকা পাঠানোর সম্ভাব্য পথ ইত্যাদি নিয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ চলছে। এছাড়া সাকিবের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট কিছু নামকেও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
সাকিবের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সমর্থকদের একটি অংশ এই তদন্তকে রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও দাবি করছে। অন্যদিকে, সমালোচকরা মনে করছেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়—সাকিবের মতো তারকাও নয়।
এই মুহূর্তে দেশের ক্রিকেট অঙ্গনে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত নাম এখন সাকিব আল হাসান। অনুসন্ধানের ফলাফলে প্রমাণিত হলে তিনি শুধু দুর্নীতির আসামিই হবেন না, তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। এখন দেখার বিষয়—এই তদন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এবং একসময় দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণার মুখ হয়ে ওঠা সাকিব কীভাবে সামাল দেন নিজের অন্ধকার অধ্যায়কে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ