
ছবি: সংগৃহীত
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গড়াতে থাকা বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট এখন এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সময়ের ঘূর্ণিতে বাঁক নিতে পারে দুই দলেরই ক্রিকেট ইতিহাস। তবে সেই বাঁকটা পজিটিভ দিকে নিতে হলে বাংলাদেশকে পার করতে হবে এক অনতিক্রম্য বলে বিবেচিত দেয়াল—২০০ রানের নিচে রান তুলে চতুর্থ ইনিংসে জয়। ইতিহাসের খাতা বলছে, এমন কিছু করতে পারেনি টাইগাররা তাদের টেস্ট ইতিহাসে কখনোই। আর এবার সেটা করতে না পারলে ম্যাচও হাতছাড়া হওয়ার সমূহ আশঙ্কা।
বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের ব্যর্থতা যেন রীতিমতো এক পরিচিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। সিলেট টেস্টের প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকরা সবেমাত্র তুলতে পারল ১৭৩ রান, যেখানে দলের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল অন্তত ২৬০ কিংবা তারও বেশি রানের পুঁজি গড়ে তোলার। অর্থাৎ প্রত্যাশার চেয়ে প্রায় ৯০ রানের ঘাটতি নিয়েই ব্যাটিং ইনিংস শেষ করতে হলো।
এই স্কোরটা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে, যা নিয়ে জেতার স্বপ্ন দেখা অনেকটা বালুকায় মহল গড়ার মতো। বিশেষ করে যখন জানা যায়—বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত কখনোই ২০০ রানের নিচে পুঁজি নিয়ে শেষ ইনিংসে জয় পায়নি।
২০১৮ সালে চট্টগ্রামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০৩ রানের পুঁজি নিয়েই সবচেয়ে কম রানের জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার ৬৪ রানে জয় এসেছিল। কিন্তু এবার তো সেই সংখ্যাও নেই পাশে। ১৭৩ রানে পুরো ইনিংস গুটিয়ে গেছে। তাহলে এবার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনার সময়?
যদিও ক্রিকেট ইতিহাসে এর চেয়ে অনেক কম রান নিয়েও জয় সম্ভব হয়েছে। এমনকি দুই অঙ্কের রান নিয়েও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০০০ সালের সেই ঐতিহাসিক টেস্টের কথা, যেখানে মাত্র ৯৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৬৫ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। তবে একথাও সত্য—সেই ম্যাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজে হয়েছিল, আর প্রতিপক্ষ ছিল তুলনামূলক শক্তিশালী দল।
বাংলাদেশ যদি ইতিহাস ভাঙার চ্যালেঞ্জে নামে, তাহলে জিম্বাবুয়ের জন্যও কাজটা ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ, দলটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তারা কখনোই ১৬২ রানের বেশি লক্ষ্য তাড়া করে জয় পায়নি। অথচ এই টেস্টে তাদের লক্ষ্য ১৭৩ রান—নিজেদের অতীত সর্বোচ্চ সফল রান তাড়ার চেয়ে ১২ রান বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, জিম্বাবুয়ে যখন রান তাড়া করে, তখন তাদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ বেশি কাজ করে। ছোট লক্ষ্যেও তারা ব্যর্থ হয়েছে একাধিকবার। এর প্রমাণ আগেই উল্লেখিত ২০০০ সালের ম্যাচ। এই ইতিহাসের চাপ হয়তো এবারও বুকে চেপে বসতে পারে।
এবার যদি মাঠের পরিসংখ্যান দেখা যায়, তাহলে কিছুটা আশার আলো ফুটে ওঠে বাংলাদেশের পক্ষে। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এখন পর্যন্ত তিনটি টেস্ট অনুষ্ঠিত হলেও, একবারও কোনো দল চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করে জিততে পারেনি। এই মাঠে চতুর্থ ইনিংসে গড় রান মাত্র ১৭৭, আর সর্বোচ্চ রান মাত্র ১৮২।
অর্থাৎ উইকেটের চরিত্র অনুযায়ী ১৭৩ রান হলেও সেটা জিম্বাবুয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জই। টানা বৃষ্টিতে উইকেট ভাঙা ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় বোলারদের জন্য সহায়ক কন্ডিশন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে স্পিনারদের জন্য।
এই ম্যাচ এখন বাস্তবতার গায়ে চেপে বসা এক অদ্ভুত দর্শনের প্রতিচ্ছবি—Irresistible Force vs Immovable Object। বাংলাদেশ কখনোই ২০০’র নিচে রান তুলে জেতেনি, জিম্বাবুয়ে কখনোই ১৬২’র বেশি রান তাড়া করে জেতেনি। এমন পরিস্থিতিতে যে দল নিজস্ব সীমা ভাঙতে পারবে, তার পক্ষেই জয়ের পাল্লা ভারি হবে।
এই টেস্ট ম্যাচ এখন আর কেবল ব্যাট আর বলের লড়াই নয়—এটা হয়ে উঠেছে ইতিহাস, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তার যুদ্ধ। যারা চাপ সামলে নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারবে, তারাই সিলেটের এই ‘প্যারাডক্স টেস্ট’ থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে যাবে।
আজই হয়তো জানা যাবে, কে হাসবে শেষ হাসি—ইতিহাস বদলে বাংলাদেশ, না আত্মরক্ষার প্রাচীর টপকে জিম্বাবুয়ে!
বাংলাবার্তা/এমএইচ