
ছবি: সংগৃহীত
সিলেটের হতাশা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। মাত্র চারদিনে শেষ হওয়া সেই টেস্ট ম্যাচে শেষ ঘণ্টা ছাড়া বাকি পুরোটা সময়ই জিম্বাবুয়ের দখলে ছিল খেলার রাশ। ফলাফল, বিব্রতকর এক পরাজয়, যা টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম হতাশাজনক অধ্যায় হয়ে গেছে। আজ সোমবার (২৮ এপ্রিল) চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাচ্ছে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট, যেখানে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে নামবে স্বাগতিক বাংলাদেশ। সকাল ১০টায় ম্যাচটি শুরু হবে এবং সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি।
এই টেস্ট বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি ম্যাচ নয়—এটি সম্মান পুনরুদ্ধারের লড়াই। একটি হারের পর দল যেভাবে চাপে পড়ে, সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে যেন আরও তীব্র। সিলেট টেস্টে হতশ্রী পারফরম্যান্সের কারণে ব্যাটাররা এবং দলীয় ব্যবস্থাপনা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বাধীন দলের নিষ্ক্রিয় ও বিরক্তিকর ব্যাটিং সমর্থকদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। গত বছর পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্টে কিছুটা সাফল্য পেলেও, ঘরের মাঠে দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ব্যর্থতা বাংলাদেশের ক্রিকেটের পুরনো ব্যাধিই আবার সামনে এনেছে।
চাপের মুখে বাংলাদেশ, সিরিজ বাঁচাতে মরিয়া প্রয়াস
জিম্বাবুয়ের সামনে এখন সিরিজ জয়ের সুবর্ণ সুযোগ। ২০০৪ সালের পর বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো টেস্ট সিরিজ জেতেনি আফ্রিকার দলটি। এমন এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সিরিজ হারার সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য বড় লজ্জার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যখন দেশের ক্রিকেটারদের বেতন, ম্যাচ ফি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট উন্নত। তবুও ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের অভাব, বিশেষ করে টেস্টে, বাংলাদেশ দলকে বারবার বেকায়দায় ফেলছে।
সিলেটের লজ্জাজনক হারের পর চট্টগ্রামে দুই দিনের অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ম্যাচের আগের দিন বিশ্রামে ছিলেন হাসান মাহমুদ, সৈয়দ খালেদ আহমেদ ও তানজিম হাসান সাকিব—তিন পেসার। নাহিদ রানা না থাকায় আজ টেস্ট অভিষেক হয়ে যেতে পারে তরুণ পেসার তানজিম হাসানের। বোলিং বিভাগ নিয়ে মোটামুটি আশাবাদী টিম ম্যানেজমেন্ট, তবে ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
উদ্বোধনী জুটিতে বারবার ব্যর্থতার চিত্র স্পষ্ট। নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুমিনুল হক উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিমও বেশ কিছুদিন ধরে টেস্টে বড় ইনিংস খেলতে পারছেন না। এরই মধ্যে দলের বাইরে থেকে হুট করে দলে ফেরানো হয়েছে এনামুল হক বিজয়কে। আজকের ম্যাচে তিনি একাদশে জায়গা পেতে পারেন, বিশেষ করে ওপেনিং ব্যাটিং লাইনআপ শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ।
চট্টগ্রামের উইকেট ঐতিহ্যগতভাবে ব্যাটিং সহায়ক হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এখানে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ততটা উজ্জ্বল নয়। সর্বশেষ এই মাঠে খেলা টেস্টেও বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল নিরাশাজনক। তাই শুধু উইকেট নয়, মানসিক দৃঢ়তাও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে এই ম্যাচে।
বাংলাদেশ দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ফিল সিমন্সও বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলেছেন। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন,
"প্রথম টেস্টে আমরা ভালো ব্যাটিং করতে পারিনি। দ্বিতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের ইতিবাচক ও আক্রমণাত্মক ব্র্যান্ডের ব্যাটিং খেলতে হবে।"
মাঠের বাইরে বিতর্কের ছায়া
মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে যোগ হয়েছে মাঠের বাইরের বিতর্কও। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তাওহিদ হৃদয়ের শাস্তি নিয়ে ক্রিকেট মহলে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এসব সমালোচনার মধ্যে মনঃসংযোগ ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ক্রিকেটারদের জীবনযাত্রার মান বিশ্বমানের হলেও, মাঠে তার প্রতিফলন হয় না—যা দেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় গভীর এক প্রশ্নবোধকচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
অন্যদিকে ইতিহাস গড়ার হাতছানি জিম্বাবুয়ের সামনে
চার বছর পর টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্বাদ পাওয়া জিম্বাবুয়ে এখন সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখছে। অধিনায়ক ক্রেগ আরভিন ম্যাচপূর্ব কথোপকথনে সতর্কতার সাথে আশাবাদী সুরে বলেন,
"প্রথম ম্যাচ জেতার প্রক্রিয়া বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এটা ভাবার দরকার নেই যে ১-০তে এগিয়ে থাকায় আমরা চাপ নিব। সিরিজ জেতার লক্ষ্য থাকবেই, তবে আমাদের ছোট ছোট ধাপে এগোতে হবে। এখনই ম্যাচের ফল নিয়ে ভাবলে চলবে না।"
২০০১ সালের পর দেশের বাইরে কোনো টেস্ট সিরিজ জেতেনি জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশের মাটিতে ২০ বছরের বেশি সময় পর সিরিজ জয় তাদের জন্য হবে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ফলে জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়দের মধ্যেও বিশেষ উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
আজকের ম্যাচের গুরুত্ব
আজকের চট্টগ্রাম টেস্ট দুই দলের জন্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য এটা সম্মান রক্ষার লড়াই, আর জিম্বাবুয়ের জন্য বহুদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটানোর সুযোগ।
বাংলাদেশের জন্য হার মানে কেবল একটি সিরিজ হার নয়, বরং একটি গভীর সংকেত—নিজেদের মাটিতেও আর সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে স্বস্তিতে থাকা যাবে না। খেলোয়াড়দের জন্যও এটা হবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার শেষ সুযোগ।
আজ দেখা যাক, হতাশা পেছনে ফেলে বাংলাদেশ কি নতুন করে দাঁড়াতে পারে, নাকি ইতিহাসের সাক্ষী হবে জিম্বাবুয়ে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ